ভয়াবহ বন্যায় ডুবছে লক্ষ্মীপুরের মানুষ, প্রতিদিন বাড়ছে পানি-থামছে না বৃষ্টি

জহিরুল ইসলাম শিবলু, লক্ষ্মীপুর: ভয়াবহ বন্যা মোকাবেলা করছে লক্ষ্মীপুরের লাখ-লাখ মানুষ। অনেকের ঘর-বাড়ি ডুবে গেছে, ডুবে গেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মসজিদ। প্রতিদিন প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পানি বেড়েছে দুই থেকে তিন ফুট। বানভাসি মানুষ জানিয়েছেন, এমন দুর্বিষহ অবস্থা ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়ও হয়নি। এবারের বন্যা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। অব্যাহত ভারী বৃষ্টি ও জোয়ারের ঢলে লক্ষ্মীপুর জেলার ৮০ শতাংশ এলাকা এখন পানির নিচে।
জানা যায়, নোয়াখালী থেকে বন্যার পানি ঢুকে লক্ষ্মীপুরের বিস্তীর্ণ জনপদ ডুবে গেছে। এর সঙ্গে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে পুরো জেলায়। এতে সময় যত যাচ্ছে বন্যা পরিস্থিতির ততই অবনতি হচ্ছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। আবার অনেকের গন্তব্য উজানে স্বজনদের বাড়ি। এর মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের গন্তব্য অজানা। অনেকে আবার চকির ওপর রান্নাবান্না করে ঘরেই অবস্থান নিয়েছেন। কোমড় পানিতে যাতায়াতে অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। এছাড়া সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। গবাধিপশু নিয়েও বিপাকে রয়েছে গৃহস্থরা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার (২৩ আগস্ট) থেকে নোয়াখালীর বন্যার পানি লক্ষ্মীপুরে ঢুকতে শুরু করে। শনিবার (২৪ আগস্ট) বিকেল থেকে পানির চাপ বেড়ে যায়। এর মধ্যে শনিবার রাত থেকে লক্ষ্মীপুরে বৃষ্টি শুরু হয়। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, উত্তর জয়পুর, বাঙ্গাখাঁ, মান্দারী, তেওয়ারীগঞ্জ, শাকচর ও চররুহিতা ইউনিয়ন প্লাবিত হয়। এসব ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ৪-৫ ফুট পানিতে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
একই সঙ্গে লক্ষ্মীপুর জেলা শহর দিয়ে বয়ে যাওয়া রহমতখালী খালসহ ওয়াপদা খালগুলোতে পানি উপচে পড়ছে। এতে লক্ষ্মীপুর পৌরসভার জে বি রোড, সমসেরাবাদ, লামচরী, মধ্য বাঞ্চানগর, পশ্চিম লক্ষ্মীপুর, মেঘনা রোড, রাজিব পুর, শিশু পার্ক, কালু হাজী সড়ক ও লাহারকান্দি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারত থেকে আসা পানিতে নোয়াখালী ও ফেনীতে যখন বন্যা তখন লক্ষ্মীপুরে প্রবল বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়ে মানুষ। এ বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের বহু মানুষ প্রায় ১ মাসজুড়ে পানিবন্দি হয়ে রয়েছেন। সদর, রায়পুর, রামগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নে পানিবন্দি হয়ে পড়েছিল মানুষ।
সর্বশেষ গত শুক্রবার নোয়াখালীর বন্যার পানি লক্ষ্মীপুরে ঢুকে পড়ে। এতে লক্ষ্মীপুরও এখন বন্যা কবলিত। এর মধ্যে শনিবার রাতেই প্রায় ৩ ফুট পানি বেড়ে গেছে বন্যাকবলিত এলাকায়। রহমতখালী খাল হয়ে মেঘনা নদীতে যেন বানের পানি নেমে যেতে পারে সেজন্য মজুচৌধুরীরহাটের দুটি স্লুইস গেট সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এরপরও কোথাও যেন পানি কমছে না। উল্টো সময়ে সাথে সাথে বানের পানি বেড়ে চলেছে। একই সঙ্গে বৃষ্টিও হচ্ছে লক্ষ্মীপুরের সর্বত্র। এতে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এবং জেলা বিএনপি, জামায়াত ইসলামীসহ বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নেতারা দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে ত্রাণ বিতরণ করছেন বন্যার্তদের মাঝে। তবে অনেকেই এখনো ত্রাণ পাননি বলে জানান।
সোমবার সকালে সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা গিয়ে পানিবন্দি মানুষের সাথে কথা হলে তাঁরা জানান, গত ৮ দিন ধরে তাদের বাড়িঘরে বৃষ্টির পানি জমে ছিল। ওই পানি না নামতেই গত ৪ দিন ধরে হঠাৎ করে পানি বাড়তে থাকে। শনিবার সারাদিন বৃষ্টি না হলেও রাতে বৃষ্টি হয়। তবে বৃষ্টির পাশাপাশি নোয়াখালীর বন্যার পানি এদিকে চাপ দেয়। এখন প্রত্যেকটি বাড়ি ৩-৪ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে। ঘর-বাড়িতে থাকার কোনো পরিস্থিতি নেই। যাদের ঘরের ভিটা উঁচু তারাই শুধু বাড়িঘরে থেকে গেছে। আর অন্যরা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি ও আশ্রয়ণ কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া জানান, এখন পর্যন্ত ২৩ হাজার ৪০৪ জন মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার্তদের মাঝে ৫০৯ মেট্রিক টন চাল, নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র  শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, সদরের রহমতখালী খাল, রামগতি, কমলনগরের ভুলুয়া নদী ও  ওয়াপদার খাল গুলো দিয়ে বন্যার পানি ঢুকায় লক্ষ্মীপুরের লোকালয়ে পানি বেড়েছে। এছাড়া গত কাল লক্ষ্মীপুরে ৪৫ মিলিমিটা বৃষ্টি হয়েছে, এতেও পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে নদীতে ভাটা এলে সব কটি স্লুইচ গেট খুলে দেওয়া হয়। আবার জোয়ারের সময় গেটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, পানিবন্দী হয়ে আট লাখ মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। জেলার পাঁচটি উপজেলাই ক্ষতিগ্রস্ত। প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গত এলাকার লোকজনকে শুকনা খাবারসহ ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে, তাঁদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

সম্পৃক্ত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button