সংগ্রাম দত্ত: বৃহত্তর সিলেট জেলা বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার সুপ্রসিদ্ধ চা নগরী শ্রীমঙ্গল থানা যোগাযোগ পূর্ণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে শুধু দেশে নয়, বহির্বিশ্বে ও পরিচিত।
সিলেট সদর থেকে ৫০ মাইল ও মৌলভীবাজার সদর থেকে ১৩ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত। বাংলাদেশের পূর্বাংশের পার্বত্য এলাকায় বহু শতাব্দীর প্রাচীন ঐতিহ্য ও গৌরবের স্মৃতি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত উন্নয়নের ক্রমধারা বিকশিত এ শ্রী অঙ্গনে শ্রীমঙ্গল গড়ে উঠেছে। পাহাড়ের পাদদেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অধিকারী চা বাগানের শোভায় শোভায় সুসজ্জিত , বন বিভাগের বৃক্ষরাজির নয়ন মনহরণকারী পর্যটন শিল্প সহ ঝর্ণার দ্বারা নিয়ে বিদ্যমান।
মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের কন্ট্রোল রুম হিসেবে পরিচিত পরিচালনা কেন্দ্রটি সকল অধিকার অতীত সকল অধিকার অর্জনের ঐতিহ্যবাহী এ শ্রীমঙ্গলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন, চা শ্রমিক আন্দোলন, আঠাশ এর কৃষক আন্দোলনে বৃটিশের পুলিশ বাহিনীকে আক্রমণ ও পর্যদস্ত করা, বালিশিরা পাহাড় আন্দোলনে কৃষকের অধিকার সংরক্ষণে দুজনের আত্মদান, চা শ্রমিকের আন্দোলনে বসন্ত, বংশীগঞ্জু সহ জানা-অজানা চা শ্রমিকের রক্তদানের ধারাবাহিকতা রক্ত শপথের তেজস্বী ভূমিকা নিয়ে আজও জাগরুক।
বিংশ শতাব্দীর উষালগ্ন থেকে এক বিংশ শতাব্দীতে পদার্পণে শ্রীমঙ্গলের স্বাধীনচেতা নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ, শিশু, কিশোর অবিস্মরণীয় ভূমিকা নিয়ে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশ বিরোধী জনযুদ্ধে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন উপলক্ষে জাতীয়তাবাদের চেতনায় ও দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত মাতৃভূমির আত্মত্যাগের আদর্শে বলিয়ান ছেলেরা সারা বাংলায় উত্তাল তরঙ্গ তুলে। বিদেশি বস্ত্রসহ পণ্য বর্জন, স্বদেশী দ্রব্যাদী গ্রহণের পক্ষে তীব্র জনজুদ্ধ শুরু করে। মুখর হয়ে ওঠে সারা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল। শ্রীমঙ্গলের স্বাধীনতাকামী ত্যাগী নেতাকর্মী ও জনতা ব্রিটিশের সুতিবস্ত্র বর্জন করতে দেশি তাঁতের বস্ত্র পরিধান করতে ও খদ্দর পড়তে শুরু করে। তারা বিদেশি পণ্য বর্জন করতে ও বিলেতি ও বিদেশী দ্রব্য বন্ধ করতে জনমত গড়ে তুলে। এ আন্দোলনে স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব দেন ফনি দত্ত পানিনি ( ভোজপুর), গিরীজা চৌধুরী ( ভোজপুর), যতীন্দ্র মোহন দত্ত ( নোয়াগাঁও), সারদা দাস তরফদার (নোয়াগাও), প্রমথ দেব (নোয়াগাঁও), নগেন ঘোষ (সিংবীজ), সুরেশ সোম (উত্তরসুর), যোগেশ চ্যাটার্জী (শ্রীমঙ্গল শহর), জিতেন পাল (রুপশপুর), বড়দা কান্ত সেন (শ্রীমঙ্গল শহর), মহেন্দ্র শর্মা (টিকিরিয়া), সূর্য মনি দেব (রামনগর), বিপিন দাস (উত্তরসূর), যতীন দেব ( শ্রীমঙ্গল শহর), মাস্টার গৌড় গোবিন্দ দেব (ভাড়াউড়া), দ্বিজেন ভট্টাচার্য (শ্রীমঙ্গল শহর), মনমোহন ভট্টাচার্য (বৌলাশী), লাকু দত্ত চৌধুরী (ভুনবীর), লীলা দত্ত চৌধুরী (ভুনবীর), নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী (কালাপুর), হৃদয় দেব (ভাড়াউড়া), অমর দত্ত ( ভৈরব বাজার), যশদা গোবিন্দ গোস্বামী ( কালাপুর), ইন্দ্র হোম চৌধুরী (রুপশপুর), মোহাম্মদ ইউনুস উদ্দিন (পাত্রীকূল), নগেন্দ্র ধর (শ্রীমঙ্গল শহর )প্রমুখ।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রচেষ্টা রদ হয়। পরবর্তী কয়েক বছরে আন্দোলন স্থিমিত হয়ে পড়ে। ১৯২০ সালে অসহযোগের রণনিনাদ দুর্বার আন্দোলনের সৃষ্টি করে।
১৯১৯ সালে লাহোর কংগ্রেসে অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে। তখন শ্রীমঙ্গল এলাকার আসাম বিধানসভার সদস্য কলকাতায় অবস্থানরত পরেশ লাল সোম কংগ্রেসের নির্দেশে সদস্য পদত্যাগ করেন। ব্রিটিশ সরকার পুনর্বার নির্বাচন দিলে ঐ সদস্যের ছোট ভাই মৌলভীবাজারে অবস্থানকারী এডভোকেট ইরেশ লাল সোম সদস্য পদ প্রার্থী হলে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা বিক্ষোভ করে। তারা ব্যঙ্গচ্ছলে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজারের চিরতন মুচিকে দাঁড় করিয়ে নির্বাচিত করেন।
১৯২২ সালে সারা ভারত জুড়ে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন এর তীব্রতায় ব্যাপক সভা, সমিতি ,ধরপাকর, জেল-জুলুম শুরু হয়। ভারতের সুনাম ধন্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম কাতারের নেতৃবৃন্দ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের জোয়ারকে বেগবতী করে তুলেন। এ সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শ্রীমতি বাসন্তী দেবী, মৌলানা মোহাম্মদ আলী মৌলভীবাজার খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের জন্য শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছান। শ্রীমঙ্গলে একদল ছাত্র তাদের মাল্য ভূষিত করে সংবর্ধনা জানায়। ওই সম্মেলনটি ১৯২১ সালের ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯২৮ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে লাহোর সেন্ট্রাল জেলে মরণজয়ী যতীন দাস দীর্ঘ ৬৩ দিন অনশন ধর্মঘট করে আত্মাহুতি দেন। শ্রীমঙ্গল ডাকঘর সড়কের মারোয়ারী কালীবাড়ি (বর্তমানে বারোয়ারী কালীবাড়ি) তে এক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আয়োজনে ছিলেন যোগেশ চ্যাটার্জী ও সতীশ সোম ।
১৯২৯ সালে রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হন যুগান্তরপন্থি সূর্যমনি দেব ও জিতেন্দ্র নাথ পাল চৌধুরী।
১৯৩০ সালে শ্রীমঙ্গলে নলিনী গুপ্তকে সভাপতি ও সুরেশ সোম কে সম্পাদক করে কংগ্রেসের শ্রীমঙ্গল থানা কমিটি গঠিত হয়।
১৯৩২ সালে গুপ্ত শাখা অনুশীলন পার্টির শ্রীমঙ্গলের সভাপতি পদে সীতেশ সোম ও সম্পাদক পদে যোগেশ চ্যাটার্জি কে বরণ করা হয়।
লবণ আন্দোলনে সীতেশ সোম অংশ নিলে নোয়াখালীতে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন। ব্রিটিশের লাল পাগড়ীধারী পুলিশ বাহিনী শ্রীমঙ্গল থানা কংগ্রেসের অফিস ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। তখন তরুণ বিপ্লবী নেতা সূর্য মনি দেব সহ মুকুন্দ চক্রবর্তী ( টিকরিয়া ), মহেন্দ্র শর্মা (টিকরিয়া), মনমোহন ভট্টাচার্য (বৌলাশি) প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা লাকু দত্ত চৌধুরী (ভুনবীর) তদ্বীয় ভগ্নি বিপ্লবী নেত্রী লীলা দত্ত (ভুনবীর), রোহিনী দাস (বৌলাশী), সারদা দে (নিশ্চিন্তপুর), সীতেশ সোম (উত্তরসূর) গ্রেপ্তার হন। জিতেন্দ্র পাল চৌধুরী ও অপর একজন ছাত্রকে ধরে ব্রিটিশ পুলিশ বেদনা প্রহার করে।
১৯৩৮ সালে বিপ্লবী কংগ্রেস নেতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু শ্রীমঙ্গলে এসে নতুন বাজারে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন ও শ্রীমঙ্গল ডাক বাংলোয় তাঁকে জলযোগ করানো হয়। এছাড়া ‘৩৬, ‘৩৮ ,’৪৫ ,’৪৬ সালে পরপর চারবার কংগ্রেস নেতা পন্ডিত জহরলাল নেহেরু বারংবার শ্রীমঙ্গলে এসে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও রেফারেনডাম উপলক্ষে সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন।
১৯৩৯ সালে সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে শ্রীমঙ্গলেও আন্দোলন তুংগে উঠে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। এসময় মোহনলাল করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী) ব্রিটিশ বিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের উপর নীতি চালিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চায়। এমতাবস্থায় মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা পরম ধর্ম ‘মারখাও, মেরোনা’ এই নীতিতে আস্থা হারিয়ে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ কংগ্রেস হতে নানাভাগে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন শুরু করে। এসময় বহু সংখ্যক নেতাকর্মী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়ে যেখানে সাদা চামড়া বা ব্রিটিশের লোক পেত সুবিধা পেলেই তাদের মেরে ফেলত।
কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগের যোগ দেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু দীর্ঘদিন স্বগৃহে অন্তরীন থাকার পর হঠাৎ অন্তর্ধ্যান করে জাপানে গিয়ে ভারতবর্ষ মুক্ত করতে সশস্ত্র বাহিনী সংগ্রহ করে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতবর্ষের কয়েকটি স্থানে আজাদ হিন্দ ফৌজ বিশাল আক্রমণ ও বোমাবর্ষণ করে। এ ফৌজ ভারতের মনিপুর রাজ্যের ইম্পল পর্যন্ত অগ্রসর ফলে খাদ্য ও অস্ত্রের অভাবে দিল্লির লালকেল্লা দখল করা সম্ভব হয়নি। জাপানসহ মিত্রশক্তি যুদ্ধে পরাজিত হলে সুভাষ চন্দ্র বসু আত্মগোপন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শ্রীমঙ্গলে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সমর্থক ও আজাদ হিন্দ ফৌজের কিছু সশস্ত্র তরণ এ আন্দোলনে শরিক হন।
১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কর্তৃক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর মুসলিম লীগের রাজনীতির ক্ষেত্র প্রশস্ত হয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় শ্রীমঙ্গলে মোঃ ইসরাইল ও আব্দুস সোবহান চৌধুরী যথাক্রমে সভাপতি ও সম্পাদক পদে নেতৃত্ব দানে মুসলিম লীগ শ্রীমঙ্গল থানা কমিটি গঠিত হয়।
মৌলভীবাজারে রাজনগরের মহিলা বিপ্লবী নেত্রী লীলা নাগের শ্রী সংঘের শাখা ও ত্রিশের দশকে গঠিত হয়। এ সংগঠন বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশ বিরোধী আক্রমণ চালিয়ে শ্রীমঙ্গলে নিরাপদ আশ্রয়ে কর্মীরা চলে আসতো। এ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন মনমোহন ভট্টাচার্য।
১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগ নেতৃত্বের আহবানে আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্যার মোঃ আসাদুল্লাহ শ্রীমঙ্গলের মতিগঞ্জ বাজারে মোঃ ইসরাইলের সভাপতিত্বে জনসভায় ভাষণ দেন।
১৯৪৬ সালে নির্বাচনী প্রচার চালাতে হোসেন শহীদ সরোয়ারদী ও নবাব জাদা লিয়াকত আলি খান শ্রীমঙ্গলের হবিগঞ্জ রোডের ঈদগাঁও মাঠে দেওয়ান আব্দুল বাছিতের সভাপতিত্বে বিরাট জনসভায় ভাষণ দেন।
১৯৪৬ সালে নির্বাচনে কংগ্রেস মনোনীত চা শ্রমিক সম্প্রদায়ের জীবন সাঁওতাল এ অঞ্চল থেকে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৪৭ সালে বরিশালের ব্যারিস্টার যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় এসে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের রেফারেনডম বা গণভোটে পাকিস্তানের পক্ষে ভোটদানের জন্য আহ্বান জানালে অধিকাংশ নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পাকিস্তানের পক্ষে গণভোটে ভোট প্রদান করে।
পাকিস্তানের পক্ষে পড়লো ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৯ ভোট আর ভারতে যোগদানের পক্ষে পড়লো ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১ ভোট। মুসলীম লীগ ৫৫ হাজার ৫শ ৭৮ ভোট বেশি পাওয়ায় সিলেট ও শ্রীমঙ্গল অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্রে চলে আসে