পাথারিয়া হিলস: বাংলাদেশ–ভারতের সীমান্তে বিপন্ন জীববৈচিত্র্যের শেষ আশ্রয়”

সংগ্রাম দত্ত: পাথারিয়া পাহাড় — মৌলভীবাজারের বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী চারটি বনবিট নিয়ে গঠিত এক বিস্ময়কর চিরসবুজ বনাঞ্চল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও অসংখ্য প্রাণীর আবাস হিসেবে সুপরিচিত এই অঞ্চলে বর্তমানে চলমান মানব আগ্রাসন, বনভূমি দখল ও অব্যবস্থাপনার ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ঝুঁকিতে। বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় সূত্র অনুযায়ী ১৯৬৭ সালে প্রায় ১,১৫২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বনাঞ্চল বর্তমান পর্যায়ে মাত্র ১৩৫ বর্গকিলোমিটারে সংকুচিত হয়ে এসেছে — যা প্রায় ৮৮.৩% ক্ষয় নির্দেশ করে। বর্তমানে এই ১৩৫ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশ অংশে প্রায় ৮৮ বর্গকিলোমিটার এবং ভারতের অংশে ৪৭ বর্গকিলোমিটার রয়েছে (অর্থাৎ বাংলাদেশ অংশের ভাগ প্রায় ৬৫.২% এবং ভারতের প্রায় ৩৪.৮%)।

ভূগোল ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য:

পাথারিয়া পাহাড় উত্তর–দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রায় ২৫ মাইল বিস্তৃত একটি পাহাড়ী অঞ্চল; জন্ম প্লায়োস্টিসিন কালের মধ্যভাগে। এখানে তিনটি প্রধান শৃঙ্গ—দূরবীনটিলা, গগনটিলা ও রাজবাড়ি টিলা—প্রতিটির উচ্চতা আনুমানিক ২৪৪ মিটার। পাহাড়ের উপরের অংশ গঙ্গামারা, নীচের অংশ মাধবছড়া; মাধবকুন্ড জলপ্রপাত এই পাহাড়ভিত্তিক বনাঞ্চলের অন্যতম ঐতিহাসিক ও ভ্রমণপ্রিয় আকর্ষণ।

জীববৈচিত্র্য:

পাথারিয়ার চিরসবুজ বনজ সম্পদে রয়েছে বড় বড় বট ও রূক্ষবৃক্ষ, বাঁশঝাড়, প্রচুর লতা-ঝোপ ও ফুলশোভিত গাছপালা — আশোক, দেবকাঞ্চন, কনকচাঁপা, পারুল, ম্যাগনোলিয়া ইত্যাদি। ফলজ বৃক্ষে আছে জাম, আম, বুনো আম, কাঠাল, বহেড়া, হরিতকি, লেবু সহ বিভিন্ন পাহাড়ি ফল। বন্যপ্রাণীর মধ্যে এশীয় হাতি, বানর, মেছোবাঘ, বনরুই, হরিণ, খরগোস, অজগর ও নানা প্রজাতির পাখি—বনমোরগ, শকুন, ঈগল, তিতির প্রভৃতি ছিল ও এখনও আছে। সম্প্রতি ক্যামেরা-ট্র্যাপিংয়ে এশীয় হাতি, ফেরেট ব্যাজার, বাঁশ ভাল্লুক, সজারু ইত্যাদি দুষ্কর ও বিপন্ন প্রজাতির উপস্থিতি ধরা পড়েছে; তবু বড় মাংসাশী প্রাণীর—বিশেষ করে চিতাবাঘ বা মেঘলা চিতার—নিরাপদ অবস্থান এখন অনিশ্চিত।

মানবচাপ ও প্রধান হুমকি:

এই বনাঞ্চলের ধ্বংসের পিছনে প্রধান কারণগুলো হলো:

প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সরকারি বনভূমি ও সীমান্তবর্তী এলাকা দখল করে বসতি স্থাপন ও পাহাড় কেটে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ;

বনায়ন নামে ফলপুষ্টির বদলে আকাঁশমনি বা ফলশূন্য মনোকালচার গাছ লাগানো, ফলে বন্যপ্রাণীর খাবার সংকট;

অবাধে চালু বাঁশ কাটাসহ গাছ কাটা, ইটভাটা, পুকুর খনন ও অপরিকল্পিত রাস্তা-পথ তৈরির কারণে আবাসস্থল খণ্ডিত হওয়া;

বনভূমি আগুন (উদাহরণ: ১১ মার্চ ২০২৩-এ প্রায় ৪০ হেক্টর বনজ একাংশ পুড়ে ছাই) ও অব্যাহত বনপালার অনিয়ম;

অবৈধ শিকার ও মধু শিকার, আঞ্চলিক শিকারিদের আগমন (কিছু রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭–১৮ সালে পার্শ্ববর্তী ভারতের থেকে শিকারিরা ঢুকেছিল) এবং আইন প্রয়োগে দুর্বলতা;

মানব–হাতি সংঘর্ষ, বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে প্রাণীর মৃত্যু ইত্যাদি।

অতীত ও সাম্প্রতিক তথ্য থেকে স্পষ্ট যে বনাঞ্চলটি যতটা টিকে আছে তা দ্রুত ক্ষয় হচ্ছে — এবং সময়মতো সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে দ্রুত থাকা কিছু প্রজাতি হারিয়ে যেতে পারে।

হাতি সংকট: সীমান্তজুড়ে করিডোরের প্রয়োজন:

পাথারিয়া–করিমগঞ্জ অঞ্চলটি একটি আন্তঃসীমান্ত হাতি করিডোর। বাংলাদেশের অংশে বর্তমানে মাত্র চারটি মেয়ে হাতি টিকে আছেন; ভারতের অংশে বিভিন্ন রিপোর্টে ছয়টি স্ত্রী হাতির কথা বলা হয়েছে — কিন্তু পুরুষ হাতির অনুপস্থিতি স্বাভাবিক প্রজনন নিয়ন্ত্রিত করছে না। সংরক্ষণবিদরা সতর্ক করেছেন যে দ্রুত পুরুষ হাতি সংযুক্ত না হলে দলের বিলুপ্তি বাস্তব সম্ভাবনা। এখানে ভারত–বাংলাদেশ মিলিতভাবে করিডোর রক্ষা, পুরুষ হাতির স্থানান্তর (IUCN গাইডলাইন অনুযায়ী) ও বাসস্থান পুনরুদ্ধারের মতো জটিল, কিন্তু অপরিহার্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
যৌথ পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে দাবি জানিয়ে
ভারতের বহুল প্রচারিত পত্রিকা দি টেলিগ্রাফ এক প্রতিবেদনে লিখেছে যে, ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার পাথারিয়া পাহাড় সংরক্ষিত বনাঞ্চল একটি সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি। এই বনাঞ্চলে বর্তমানে মাত্র ছয়টি স্ত্রী হাতি রয়েছে, যার মধ্যে পুরুষ হাতির অনুপস্থিতি প্রাকৃতিক প্রজননকে বাধাগ্রস্ত করছে। গবেষকরা সতর্ক করেছেন যে, যদি দ্রুত একটি পুরুষ হাতি স্থানান্তর না করা হয়, তবে এই হাতির দলটি বিলুপ্তির মুখে পড়বে।
এই বনাঞ্চলটি ৭৬.৪৭ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এবং এটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত, যেখানে হাতিরা নিয়মিতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে। এই আন্তঃসীমান্ত চলাচল যৌথ সংরক্ষণ প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এবং স্থানীয় এনজিওগুলি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ উদ্যোগের আহ্বান জানিয়েছেন, যেমনটি সুন্দরবনের সংরক্ষণ প্রকল্পে সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে।

করণীয়: এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:

একটি দীর্ঘমেয়াদি ও বাস্তবায়ন যোগ্য সংরক্ষণ পরিকল্পনা ছাড়া পাথারিয়া বাঁচানো সম্ভব নয়। প্রস্তাবিত কার্যক্রমগুলো হচ্ছে:

পাথারিয়ার বাকি অব্যাহত প্রাকৃতিক বনাঞ্চলকে দ্রুত আইনিভাবে সংরক্ষিত এলাকা (protected area / wildlife sanctuary) ঘোষণা করা;

অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে সুসংহত ও স্বচ্ছ আইনগত প্রক্রিয়া, ভূমি-নিরীক্ষা ও পুনরুদ্ধার কর্মসূচি চালু করা;

বনায়নে স্থানীয় ফলজ ও বনজ প্রজাতির পুনঃউদ্ভব, মনোকালচারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক খাদ্যবৃক্ষ রোপণ;

জাতীয় ও সীমান্তসাম্পর্কীয়ভাবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ সংরক্ষণ-অফিস স্থাপন করে করিডোর রিকনেকশন ও অপ্রতিবন্ধক গতি নিশ্চিত করা;

ক্যামেরা-ট্র্যাপিং, নিয়মিত মনিটরিং, এনজিও ও বেসরকারি অংশীদারিত্বে anti-poaching টিম বৃদ্ধি;

স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও কৃষকদের জন্য ক্ষতিপূরণ, বায়ো-ফেন্সিং, বিকল্প আয়-উৎপাদন ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি;

বিপজ্জনক ইঞ্জিনিয়ারিং (বৈদ্যুতিক তার) সংশোধন ও মানুষের–প্রাণীর সংঘাত কমাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া;

বিপন্ন প্রাণীর টেকসই রিহ্যাবিলিটেশন/ট্রান্সলোকেশন পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে প্রণয়ন।

পাথারিয়া কেবল একটি বন নয়—এটি একটি জীববৈচিত্র্য করিডোর, ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার। সময় এখন আর অপেক্ষা করে না; সরকারি কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন, বন বিভাগ, গবেষক, এনজিও ও স্থানীয় জনগণকে মিলেমিশে অবিলম্বে কার্যকরী ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে পাথারিয়ার হারানো যুদ্ধ হবে শুধু বাংলার বা আসামের নয়—এটি হবে সীমান্তজুড়ে এক অনন্য বাস্তুসংস্থান ও বিশ্বজুড়ে এক গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য হটস্পটের অংশ হারানোর গল্প

সম্পৃক্ত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button