দিন ধরে কাঁদতে কাঁদতে সুদাম সুএধর   বিলাপ করে বলছে দুনিয়ায় আমার কেউ রইল না

জেলা প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জ: দু-দিন ধরে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে এসেছে সুদাম সূত্রধরের। ভাঙা গলায় চিৎকার করে শুধু বলে যাচ্ছেন, ‘দুনিয়ায় আমার আর কেউ রইলো না’।
কয়েকদিন আগে বাবার মৃত্যু। এরপর মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী ও দুই মেয়ের মৃত্যুতে নিঃস্ব দরিদ্র কাঠমিস্ত্রি সুদাম।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার খুকনী জুগীবাড়ি গ্রামে সুদামের শ্বশুরবাড়ি বিনয় চন্দ্র সূত্রধরের বাড়িটিতে চলছে শোকের মাতম। বাড়ির উঠোনে যেখানে তিনজনের মরদেহ রাখা হয়েছিল, রশি টানিয়ে চিহ্নিত করে রাখা সেই স্থানটিকে ঘিরে বসে রয়েছেন সুদাম সূত্রধর, তার শ্বশুর বিনয় সূত্রধর, শাশুড়ি আন্না রানী সূত্রধরসহ পরিবারের সদস্যরা।
কেউ কাঁদছেন, কেউ ইষ্টনাম জপ করছেন। প্রতিবেশীরা এসেও এই পরিবারটিকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে না পেয়ে চোখের জল ঝরিয়ে যাচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার (১ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টার দিকে হাটিকুমরুল-পাবনা মহাসড়কে উপজেলার মাদলা নামক স্থানে বাসের ধাক্কায় সিএনজি চালিত অটোরিকশার যাত্রী সুধন সূত্রধরের স্ত্রী মিতু বিশ্বাস (৩০) ও শিশু মেয়ে ইচ্ছামনি (৭) ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরেরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় কথামনিও (১৩) মারা যায়।  
এ ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে মিতু রানীর বোন পলি রানী সূত্রধর। এছাড়াও গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন সুদাম সূত্রধরের বড় বোন অরুণা রানী সূত্রধর ও ভাগনে সৌরভ সূত্রধর। আহত অটোরিকশা চালক সাঁথিয়া উপজেলার তাইমূল ইসলামকে (২৫) ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
নিহতদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, সুদাম সূত্রধর পাবনা জেলার সাথিয়া উপজেলার নারিন্দা গ্রামের নির্মল চন্দ্র সূত্রধরের ছেলে। তিনি শাহজাদপুরের খুকনী জুগীবাড়ি গ্রামের বিনয় চন্দ্র সূত্রধরের মেয়ে মিতু সূত্রধরকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এলাকায় একটি ভাড়া বাসা নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
পুরো পরিবারের উপর ঘটে যাওয়া এ দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে সুদাম সূত্রধর বলেন, পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার চিনাখড়া গ্রামে ভাগনির বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানে আমার স্ত্রী-দুই মেয়ে, শ্যালিকা, বড় বোন ও ভাগনে যাচ্ছিলেন। সকালে আমি নিজে গিয়ে ওদের সিএনজিতে তুলি দিয়ে এসেছি। এরপর আমি কাজে এসে পড়ি। কাজ শেষে বিকেলে আমার যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সকাল ১১টার দিকে আমার কাছে ফোন এলো। আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখলাম আমার স্ত্রী আর নেই। কিছুক্ষণ পরে আমার ছোট মেয়েটাও মারা গেল। পরদিন সকালে বড় মেয়েও মারা যায়। শ্যালিকা, বোন ও ভাগনে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
সুদাম আরও বলেন, ২২ দিন আগে আমার বাবা মারা গেছেন। সবেমাত্র শ্রাদ্ধাদি শেষ করে এলাম। এখন আমার পরিবারের আর কেউ রইলো না।
সুদামের শ্বশুর বিনয় সূত্রধর বলেন, আমার বড় মেয়ে ও দুই নাতি মারা গেছে। আমার ছোট মেয়ে পলি রানীর এখনও জ্ঞান ফেরেনি। অপারেশন করতে নাকি অনেক টাকা লাগবে। আমি দরিদ্র মানুষ এতো টাকা কোথায় পাব? ভগবানের কাছে বলি আমার ওই মেয়েটিকে ফিরে দিক। কাঁদতে কাঁদতে পাগলপ্রায় সুদামের শাশুড়ি আন্না রানী বলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেলো।
নিহত মিতুর চাচা বিপেন সূত্রধর বলেন, ঘটনার দিন দুজন মারা যায়। আহতদের বগুড়া হাসপাতাল ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে পলি সূত্রধরকে ঢাকার নিউরোসাইন্স হাসপাতালে ও সৌরভ সূত্রধরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের এখনও জ্ঞান ফেরেনি। অপর আহত অরুণা সূত্রধর (৪৫) এনায়েতপুর খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আহতদের চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। আমাদের মত হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে এতো টাকার জোগাড় করা সম্ভব নয়। তাই এ ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সাহায্য প্রার্থনা করছি।
শাহাজদুপর পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানিক সরকার বলেছেন, আমরা নিহতদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। এ পরিবারটিকে বাঁচাতে আমরা ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলবো।
হাটিকুমরুল হাইওয়ে ট্র্যাফিক ইন্সপেক্টর মনিরুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় নিহত মিতুর চাচা বিপেন সূত্রধর বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে মামলা দায়ের করেছেন। রাতেই শাহজাদপুর ট্রাভেলসের বাসটিকে জব্দ করা হয়। শুক্রবার বাসের চালক আমিরুল ইসলাম নাজমুলকে (৪৪) পাবনা থেকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, নিহতদের পরিবারকে আমরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবো। স্থানীয় চেয়ারম্যানকে বিষয়টি দেখতে বলা হয়েছে।

সম্পৃক্ত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button