সত্য বলার অপরাধেই কি খুন হচ্ছেন সাংবাদিকরা? রাষ্ট্র যেন নীরব দর্শক

✍️ মাহবুব :সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক: গীতিকার গান লেখেন, সুরকার তাতে সুর দেন, আর শিল্পীর কণ্ঠে সেই গান হয়ে ওঠে সুমধুর। কিন্তু কোনো গানের কথা যদি বাস্তব কোনো ব্যক্তির নামের সাথে মিলে যায়, তবে কি শিল্পীর গাওয়াটা অপরাধ? একটি সৃষ্টিশীল কাজ যদি কারও ব্যক্তিগত অনুভূতিকে সরাসরি আঘাত না করেও ‘উসকানি’র অভিযোগে বিদ্ধ হয়, তাহলে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি?
প্রশ্নটা জরুরি। তবে আজকের আলোচনা কেবল শিল্প বা গান নিয়ে নয়—আজকের কথা সাংবাদিকতা এবং এক ভয়ানক, নির্লজ্জ রাতকে ঘিরে।

🔹গাজিপুরে সাংবাদিক খুন: আরেকটি সত্যের কণ্ঠরোধ
গত রাতে গাজীপুর চৌরাস্তায় খুন হয়েছেন স্থানীয় এক গণমাধ্যমকর্মী। নিহত সাংবাদিক ছিলেন দুর্নীতি আর অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে এক সোচ্চার কণ্ঠ। স্থানীয় প্রভাবশালীদের নানা অপকর্ম নিয়ে তিনি একের পর এক প্রতিবেদন করেছেন। সেই সত্য বলার দায়েই কি তাকে প্রাণ দিতে হলো? এটি নিছক হত্যাকাণ্ড নয়—এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হত্যা। এই আক্রমণ স্বাধীন সাংবাদিকতার মূলে আঘাত হেনেছে।
রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি
প্রতিবার সাংবাদিক খুনের পর আমরা একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখি—
কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের স্ক্রলে প্রতিবাদ।
প্রেস ক্লাবের সামনে কয়েকটি মানববন্ধন।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে “দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের” অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতি।
কিন্তু বাস্তবতা কী? খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, ভুক্তভোগী পরিবার বিচার পায় না, আর বেঁচে থাকা সাংবাদিকেরা আরও শঙ্কিত, আরও চুপ হয়ে যান। রাষ্ট্র যেন এক্ষেত্রে কেবলই এক নীরব দর্শক, যার ভূমিকা কয়েকটি বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ।

🔹অস্ত্রহীন যুদ্ধ: বাংলাদেশের সাংবাদিকতার চালচিত্র
বাংলাদেশে গত এক দশকে ২৫ জনের বেশি সাংবাদিক খুন হয়েছেন, আর আহত হয়েছেন শতাধিক। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করলেই নেমে আসে হুমকি, গুম, হামলা কিংবা মামলার খড়্গ। অধিকাংশ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয় না, বিচার তো দূরের কথা। সাংবাদিকতা এখন আর কেবল একটি পেশা নয়—এটি জীবন বাজি রেখে সত্য বলার এক অসম যুদ্ধ। বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের নিম্নমুখী অবস্থান এটাই প্রমাণ করে যে, এখানে সত্য বলার পরিবেশ কতটা প্রতিকূল।

🔹কলমযোদ্ধাদের রক্ষায় চাই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ
সাংবাদিকদের সুরক্ষায় বাংলাদেশে আজও কোনো পৃথক আইন প্রণীত হয়নি। প্রেস কাউন্সিল আইন থাকলেও তা কার্যত নিষ্ক্রিয়। এই অচলাবস্থা ভাঙতে এখনই জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
১. সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার বিচার ত্বরান্বিত করতে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা।
২. অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৩. প্রতিটি থানায় সাংবাদিক সহায়তা ডেস্ক চালু করা।
৪. সাংবাদিক হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ নিশ্চিত করা।

🔹না হলে সব গান থেমে যাবে…
একজন সাংবাদিক খুন হওয়া মানে শুধু একটি পরিবার নিঃস্ব হওয়া নয়; এর অর্থ একটি সত্যের কণ্ঠস্বরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া। আজ যারা এই বর্বরতার বিরুদ্ধে চুপ করে আছেন, কালকের আগুন তাদের ঘর পর্যন্তও পৌঁছাতে পারে।
যে সমাজে সত্য বলা অপরাধ আর মিথ্যাচারই নিরাপদ আশ্রয়, সেই সমাজ আর যা-ই হোক, সভ্য হতে পারে না। আমরা যদি এখনই এই কলমযোদ্ধাদের পাশে না দাঁড়াই, তবে একদিন এই অন্ধকার আমাদের সবার কণ্ঠ রুদ্ধ করে ফেলবে। গান থেমে যাবে, কলম ভেঙে যাবে, আর আমরা ইতিহাসের পাতায় কেবলই এক হাহাকারের গল্প হয়ে বেঁচে থাকব।

📌 লেখক: মাহবুব সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button