
আব্দুল্লাহ আল মামুন: আজ ৮ই আগস্ট, ২০২৫। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শহীদ, লেখক, সাংবাদিক ও সমাজসেবক প্যারী মোহন আদিত্যের ৫৪তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে তিনি নির্মমভাবে শহীদ হন।
জীবন ও কর্ম:
প্যারী মোহন আদিত্য ছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রবর্তিত সৎসঙ্গের একজন একনিষ্ঠ সেবক। তিনি সৎসঙ্গ সংবাদ পত্রিকার সহ-সম্পাদক, সৎসঙ্গের কার্যকরী পরিষদের সদস্য এবং সকল ধর্মের মিলনক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত পাকুটিয়া আশ্রমের প্রাণপুরুষ ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ভারতের দেওঘর থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ব্যবহৃত পাদুকা বহন করে এনে পাকুটিয়ায় এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজও সেখানে সযত্নে প্রদর্শিত হচ্ছে। এর আগে, ১৯৫৭ সালে ঠাকুরের বাণী ও আদর্শ প্রচারের লক্ষ্যে তাঁর যুগ্ম সম্পাদনায় ‘সৎসঙ্গ সংবাদ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ও তাঁর অটল প্রতিরোধ:
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঢেউ টাঙ্গাইলেও এসে পৌঁছায়। ১৮ই এপ্রিল পাক-বাহিনী টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার পথে পাকুটিয়া আশ্রমে হামলা চালায়। তাদের ছোঁড়া শেলে মন্দিরের চূড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময় প্যারী মোহন আদিত্য নিঃসঙ্গ চিত্তে মন্দিরে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। হানাদাররা তাঁকে কোনো জীবন্ত মানুষ না ভেবে প্রতিকৃতি মনে করে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে চলে যায়।
কিন্তু হানাদারদের নজর তাঁর উপর ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা সন্দেহে ২১শে মে তারা আশ্রমে পুনরায় অতর্কিত আক্রমণ চালায় এবং প্যারী মোহন আদিত্যকে ধরে ঘাটাইল ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তবে অদম্য সাহসী এই মানুষটি সেখান থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।
৮ই আগস্ট: চূড়ান্ত আত্মদান:
অবশেষে আসে সেই কালদিন, ১৯৭১ সালের ৮ই আগস্ট। ১১ নং সেক্টরের কাদেরিয়া বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার বীর প্রতীক আলহাজ্ব খোরশেদ আলম তালুকদারের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে অবস্থান করছিলেন।
ঐদিন আনুমানিক বিকেল ৩টায়, টাঙ্গাইল থেকে মধুপুরগামী পাক-বাহিনীর একটি দল আশ্রমে মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতির সন্দেহে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। দুই পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে একটি গুলি প্যারী মোহন আদিত্যের তলপেটে বিদ্ধ হয়। আহত অবস্থায় তাঁকে ধরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা।
অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান জানতে চেয়ে তাঁর উপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে, লাথি মেরে রক্তাক্ত করা হলেও দৃঢ়চেতা প্যারী মোহন আদিত্য মুখ খোলেননি। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো তথ্য না পেয়ে হানাদাররা তাঁকে সেখানেই নির্মমভাবে হত্যা করে।ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ, অকুতোভয় এই শহীদের আত্মত্যাগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর ৫৪তম প্রয়াণ দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।