মর্ত্যলোকে চট্টলের মেধস মুনির আশ্রমে সর্বপ্রথম পৃথিবীর দূর্গা পূজার প্রচলন : মন্দিরের ৫৫ একর ভূমি বেদখল

সংগ্রাম দত্ত: বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার কড়লডেঙ্গা পাহাড়চূড়ায় রয়েছে শ্রী শ্রী চন্ডীতীর্থ ও মেধস আশ্রম। দেবীর আবির্ভাব স্থান মেধস আশ্রম পৌরাণিক শত সহস্র বছরের পবিত্র তীর্থভূমি। পবিত্র এই তীর্থভূমিতে হাজার হাজার বছর আগে দেবী ভগবতীর আর্বিভাব ঘটেছিল বলে জনশ্রম্নতি রয়েছে। এই মেধস আশ্রমে মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে সর্বপ্রথম মর্ত্যলোকে দশভূজা দুর্গাদেবীর পূজা শুরু হয় বলে বিভিন্ন পৌরাণিক গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।

প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত পবিত্র এই তীর্থভূমি চট্টগ্রাম জেলা শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে কড়লডেঙ্গার ৫০০ ফুট উচ্চ শিকড়ে সন্ন্যাসী পাহাড়চূড়ায় এই আশ্রম অবস্থিত। কালের আবর্তে সেই পীঠস্থান অবলুপ্ত হয়ে পড়েছিল। পুরাকালে এই আশ্রমের কথা শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ থাকলে সাধারণ্যে তার প্রকাশ বা প্রচার ছিল না। যা’ কলি কালের শত শত বছর পূর্বে প্রচার লাভ করে।

গৌরীতন্ত্রের কামাখ্যা পটলে এই আশ্রমের বিবরণ মতে
কর্ণফুলী মহানদী গোপর্বত সমুদ্ভবা। তস্যাশ্চ দক্ষিণে তীরে পর্বতঃ পূণ্যাবিত্তমঃ ॥ তত্র দশমহাবিদ্যা গঙ্গানাভি স্বরূপিণী। মার্কণ্ডেয় মুনেঃ স্থানং মেধসোমুনেরাশ্রমঃ ॥ তত্রচ দক্ষিণাকালী বানলিঙ্গং শিবঃ স্বয়ং ॥ ইতি গৌরী তন্ত্রীয় কামাখ্যা পটলে দেবী মাহাত্ম্য বর্ণন প্রসঙ্গেন সমুদ্ভাসিতম্। অন্যদিকে কামাখ্যাতন্ত্রে বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয় যে,
কর্ণফুলীং সমারাভ্য যাবদ্দক্ষিণ সাগরম্।

পুণ্যক্ষেত্রমিদং প্রোক্তং মুনিগণবিসেবিতম্ ॥

যত্রাস্তি বেতসা নাম্নী দিব্যা পুন্যাতোয়া নদী।

তত্রৈবাসীম্মুনি শ্রেষ্ঠ মেধসঃ ঋষিরাশ্রমঃ ॥

ইতি কামাখ্যাতন্ত্রে পঞ্চত্রিংসাৎ পটলে সিদ্ধস্থান

বর্ণন প্রসঙ্গেন সমুদ্ভাসিতম্।।

এতদ্ব্যতীত যোগিনীতন্ত্রে এই মার্কণ্ডেয় আশ্রমের কথা এবং তৎসন্নিহিত চতুর্ধনু পরিমিত মার্কণ্ডেয় কুন্ড ও মার্কণ্ডেয় পদচিহ্ন ইত্যাদি উল্লিখিত আছে।

শ্রীমদ বেদানন্দ স্বামী যোগ সাহায্যে এই মেধসাশ্রমের সন্ধান পান। সেই আশ্রম উক্ত শাস্ত্রোক্ত চিহ্ন আজো অক্ষুন্নভাবে বিদ্যমান আছে। স্বামীজি বহু আয়াসে, বহু হিংস্রজন্ত সমাকীর্ণ নিবিড় অরণ্যসমাকুল পর্বত প্রদেশে প্রবেশ করিয়া এই তীর্থ আবিষ্কার করেন।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এই আশ্রম চট্টগ্রাম জেলা শহরের অতি নিকটে অবস্থিত। অদ্র পল্লী সারোয়াতলী হইতে আশ্রম পর্বতের সানুদেশ প্রায় এক ক্রোশ ব্যবধান। আশ্রমের শোভা অতি রমণীয়। সঘন শ্যামল তরুলতা শোভিত পর্বতস্তরে মেধসাশ্রম। পর্বতস্তরের নিম্নভাগে চম্পকারণ্য। চম্পকারণ্যের উভয় পার্শ্বস্থ পর্বত বাহুর উপর দিয়ে আশ্রমে আরোহণের পথ। বামবাহুর বামভাগে নাভিগঙ্গা। ঐ গঙ্গা নাভি-সদৃশী গভীর কুণ্ডাকারে বিরাজমান। সেই কুণ্ড মধ্যে পর্বত নির্ঝরিণীর নির্ঝর-নিকর সুমধুর ধ্বনিতে অবিরাম ধারায় প্রবাহিত। জল অতি মধুর। পর্বত বাসী দেবতাবোধে ঐ কুণ্ড পূজা করে। তদূর্ধ্বে বিষ্ণুপদ লাঞ্ছিত, শঙ্খ-চক্রচিহ্নিত অনেক কুণ্ড বর্তমান।

নাভিগঙ্গার নিম্নদেশে ত্রিশুল চিহ্নিত ব্যাসকুণ্ড। উপরিস্থ অধিত্যকা ভূমিতে মেধসাশ্রম। উহার দক্ষিণাংশে নানাবিধ সুরভি কুসুম ভূষিত সুরথকুণ্ড ও বৈশ্যকুণ্ড বিরাজমান । আশ্রম সম্মুখে একটি প্রাচীন বিল্বতরু ও চারিদিকে আমলকী কানন। ঐ আশ্রমে সন্নিহিত পূর্বাংশে চতুর্ধনু পরিমতি মার্কণ্ডেয় কুণ্ড। পূর্বোক্ত পর্বত নির্ঝরিণী দ্বিধা হয়ে এক ধারায় নাভি- গঙ্গায় ও অপর ধারায় এই মার্কণ্ডেয় কুণ্ডে প্রবাহিত। মার্কণ্ডেয় কুণ্ডে কচ্ছপাকৃতি পাষাণখন্ড বিরাজিত। কুণ্ডের উপরিভাগে মার্কণ্ডেয় ঋষির পদচিহ্ন বর্তমান রয়েছে। তদূদ্ধে মার্কণ্ডেয় আশ্রম ও দশমহাবিদ্যার স্থান স্তরে স্তরে বিরাজমান। উভয় আশ্রমের দৃশ্য অতি মনোহর। আশ্রম- পথে প্রবেশ করলে চিত্তপ্রসাদ উদ্ভব হয়। আশ্রম শোভা বর্ণনাতীত।

মেধা ঋষি কথিত এবং মার্কণ্ডেয় কর্তৃক পুনরুজ্জীবিত চণ্ডীর অর্চনা প্রাচীনতম যুগ হতে বাঙ্গালায় প্রচলিত ছিল, ইহা উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীকালে ব্রহ্ম- শক্তির অবতার শ্রীরামচন্দ্রের দুর্গাপূজাকেই বাঙ্গালী তার সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি-আরাধনারূপে মনোনীত করে।

চণ্ডীর বর্ণনা মতে সুরথরূপী সাবর্ণি মনু, ঋষি মেধার নিকট তাঁর আশ্রমে বণিক সমাধির সহিত এই ‘চণ্ডী’ শ্রবণ করেন ও তন্ত্রোক্ত সাধনা মতে শক্তি-পূজায় উদ্দীপিত হন। চণ্ডীতে প্রারম্ভিক শ্লোকে উক্ত আছে যে,

সাবর্নিঃ সুর্যতনেয়ো যো মনুঃ কথ্যতেইষ্টমঃ। নিশাময় তদুৎপত্তিং বিস্তারদ্গদতো মম ॥

মৃকণ্ডের পুত্র মার্কণ্ডেয় স্বীয় ত্রিকালদর্শী অভিজ্ঞতায় সপ্তসল্প- জীবীরূপে বলেন যে, সাগর কন্যা সবর্ণার গর্ভে সূর্যের ঔরসে যে পুত্র হয়, তিনি অষ্টম মনু সাবর্ণি হলেও পরে তিনিই সুরথ নামে পরিচিত হন। চণ্ডীতে উক্ত হয়েছে যে, বহু কোটি বৎসর পূর্বে মেধসাশ্রমে ঋষি মেধা সুরথকে এই শক্তি-তত্ত্ব বুঝিয়ে দেন।

মেধসাশ্রম হচ্ছে ‘শক্তির’ প্রথম সঞ্চার। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে যে, মেধা ঋষি ব্রহ্মার পৌত্র এবং প্রচেতার পুত্র। স্বয়ং শঙ্কর মেধামুনির দীক্ষাগুরু। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে অবশ্য সুরথকে চন্দ্রবংশীয় এবং চন্দ্রের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ রূপে বর্ণনা করেছেন। চণ্ডীতে কিন্তু সুরথ চৈত্র-বংশোদ্ভব রূপে খ্যাত।

সুরথ ছিলেন ‘কোলা’ রাজ্যের রাজা। বাঙ্গলার বিশেষ একটি অংশ তখন ‘কোলা’ নামে অভিহিত হত। চণ্ডীতে উক্ত আছে রাজা সুরথের শত্রুগণ ‘কোলা-বিধ্বংসী।’ ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও কোলাধ্বংসকারী বৈষ্ণব বীরের নাম নন্দী। এই নন্দীর পিতাই ছিলেন ধ্রুব-নন্দন উৎকল। উৎকল- কুমার নন্দী বৈষ্ণব ধর্মীরূপে শাক্তধর্মী সুরথকে আক্রমণ করেন। এক্ষণে এই উৎকল হতে যদি বর্তমান ‘উৎকল’ প্রদেশের নামকরণ হয়ে থাকে তবে ইহা অণুমান-সিদ্ধ যে কোলাবিধ্বংসী উৎকল রাজ কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে বঙ্গাধীপ সুরথ পলায়ন করেন।

চণ্ডীর উক্তি অনুসারে পুষ্পভদ্রা নামক নদীর নিকট তিনি সমাধি নামক বৈশ্যের সহিত মিলিত হন ও উভয়ে পুষ্পভদ্রা পার হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে মেধসাশ্রমে উপনীত হন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে এই বৈশ্য সমাধিও কলিঙ্গ দেশবাসী। কলিঙ্গ উৎকলের অপর নাম। অতএব বঙ্গ ও কলিঙ্গের দুই পুরুষ পদব্রজে, পূর্বাভিমুকে অগ্রসর হয়ে, পার্বত্য প্রদেশে অরণ্য সঙ্কুল নির্জন স্থানে মেধসাশ্রমে উপস্থিত হলেন। বঙ্গের প্রান্তে, নদীর অপর পারে পার্বত্য প্রদেশ প্রাগজ্যেতিষপুর বা কামরূপ অথবা আরো দুরে চন্দ্রনাথের পথেই মেধসাশ্রমের নির্দিষ্ট স্থানরূপে অনুমিত হয়।

শক্তি পুজার মূল কাহিনীর উৎপত্তিস্থল এই বাঙ্গলা। বাঙ্গলার কোলেই চট্টলের একান্ত নিজনি চন্দ্রনাথ পর্বতের সানুদেশেই মহামুনি মেধার আশ্রম অবস্থিত ছিল।

চণ্ডীর বিভিন্ন-রূপে যে প্রকাশ, প্রচার ও অর্চনা-চণ্ডিকা, কালিকা, জগদ্ধাত্রী মহিষমর্দিনী ও দুর্গাসুর নিধনকারিনী দুর্গা প্রভৃতি শক্তির সেই বিভিন্ন রূপের মধ্যে কোশল যে কল্পে বা যুগে যে রূপেরই পূজা করে থাকুন তর্ক তা নিয়ে নয়।
বাঙ্গলা দেশ দেবীর ঐ দুর্গা প্রতিমা- খানিই বরণ করে তুলে চট্টলের শান্ত পর্বত শিখরে মেধসাশ্রমে আপন সাধনার জন্য। পৌরাণিক আখ্যায়িকা বা সাধকবর্গের প্রাচীন কিম্বদন্তী অনুসারে, নানা নিদর্শন ও আবহমান কালের ধারনা ও আরাধনায় এই চন্দ্রনাথকে দ্বিতীয় কাশী বা স্বর্গতুল্য ধর্মপীঠরূপে কীর্তিক হতে দেখা হয়। মৎস্যগন্ধার পুত্ররূপে ব্যাসদেব কাশীধামে সাধনার অধিকার না পাওয়ায় আপন সাধনশক্তি ও শিবববের এই চন্দ্রনাথে দ্বিতীয় কাশীর প্রতিষ্ঠা করেন। মহর্ষি কপিলও স্বয়ং এই চন্দ্রনাথে শক্তি সাধনায় রত হন। তাছাড়া, ইহা পীঠস্থান তো বটেই। “চট্টলে দক্ষ বাহ্যর্মে, ভৈরবশ্চন্দ্রশেখর।” এরূপ পুরাণ বর্ণিত ব্যাস- কপিল-সাধনাপুত এক পবিত্রতম পর্বতেই যে সাধকবর মেধা মুনিরও আশ্রমস্থল হিসেবে বিবেচিত ।

গৌরীতন্ত্রে লিখিত আছে যে, কলিকালে উক্ত আশ্রম প্রকাশিত হবে।

হাজার হাজার বছর আগে গভীর শ্বাপদ সঙ্কুল অরণ্যে আশ্রম নির্মাণ করে মেধস মুনি নামের এক মহাযোগী গভীর আধ্যাত্ম সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন। সেই সময়ে সুরথ নামের এক রাজা রাজ্যহারা হয়ে এবং সমাধি নামের এক বৈশ্য আত্মীয়দের দ্বারা প্রতারিত ও বিতারিত হয়ে ঐ অরণ্যে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
দুই দুঃখী বন্ধু ঋষি সমীপে উভয়ের দুর্ভাগ্যের কথা বর্ণনা করে দুর্ভাগ্যমুক্তির জন্য ঋষির অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন।

নিবিষ্টচিত্তে উভয়ের দুর্ভাগ্য কাহিনী শুনে ঋষি তাদের কাছে দেবী দূর্গার সৃষ্টি কাহিনী ও তাঁর অলৌকিক শক্তি সম্পর্কে বর্ণনা দেন। অমিত শক্তিশালী দানবদের কাছে যুদ্ধে পরাভূত হয়ে দেবতারা স্বর্গত্যাগে বাধ্য হন। স্বর্গচ্যুত দেবতাগণ সমবেত হয়ে একাগ্র ধ্যানে প্রত্যেকের নিজনিজ শক্তি একীভূত করে অপূর্ব সুন্দরী, ত্রিনয়না, দশভূজা, অমিততেজা দেবী মুর্তি সৃষ্টি করেন। দেবতাগণ নিজ নিজ অস্ত্র অর্পণ করে দেবী চণ্ডীকে সজ্জিত করেন। শক্তিময়ী দেবী দশহস্তে দশ প্রহরণ ধারণ করে সিংহ বাহনে আসীন হয়ে একাই যুদ্ধ করে সকল অসুরদেরকে বধ করে দেবতাদেরকে শংকামুক্ত করে স্বর্গচ্যুত দেবতাদেরকে পুনরায় স্বর্গে পুনর্বাসিত করেন।

রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যকে দশভূজা দেবী দূর্গার পূজা করে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনার জন্য পরামর্শ দিলেন ঋষি মেধস। মুনি মেধসের নির্দেশ মত আশ্রম চত্বরে উভয়ে দেবীর মৃন্ময়ী দশভূজা মূর্তি নির্মাণ করে চৈত্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠী থেকে দশমী অবধি একাগ্রচিত্তে আরাধনা করে দেবীর অনুগ্রহ লাভে সক্ষম হন। পরে রাজা সুরথ হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারে ও সমাধি বৈশ্যও বৈরী স্বজনদের স্নেহালীঙ্গন লাভে সক্ষম হন।

মর্ত্যলোকে সুরথ ও সমাধি কর্তৃক সর্বপ্রথম দেবী দুর্গার পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন মেধসমুনির পবিত্র আশ্রম চত্ত্বরই হচ্ছে পৃথিবীতে দেবী দূর্গার প্রথম পূজাস্থল।

বসন্তকালের এই পূজার নাম বাসন্তীপূজা। এর হাজার হাজার বছর পরে দেবীর কৃপায় রাবণ বধ করে সীতা উদ্ধারের জন্য পরমপুরুষ শ্রীরাম অসময়ে আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন। শরৎকালের এই পুজার নাম শারদীয়া পূজা। অকালবোধন সামেও এই পূজা পরিচিত।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় গৃহস্থাশ্রমে স্বামীজির নাম ছিল চন্দ্রশেখর। শীতলচন্দ্র নামেও তিনি সম্বোধিত হতেন। বরিশাল জেলার অন্তর্গত গৈলা গ্রামের সামবেদোক্ত কুথুমশাখীর বৈদিকশ্রেণীর সাবর্ণ ব্রাহ্মণদের বংশে ১২৬৬ বাংলা সনে ২৫শে অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা তিথিতে চন্দ্রশেখর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জগদ্বন্ধু পণ্ডিত এবং প্রপিতামহ রামকৃষ্ণ ন্যায়পঞ্চানন পূর্বাঞ্চলে একজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও পৌরাণিক ছিলেন।

চন্দ্রশেখরের দুই বৎসর বয়সের সময় পিতার লোকান্তর হয়। তাঁর জননী ভিক্ষা দ্বারা অতিকষ্টে ঐ পুত্র ও কন্যাত্রয় পালন করেন। বাল্যকালে চন্দ্রশেখরের লেখাপড়া বিশেষ কিছু হয়নি। গ্রামস্থ পাঠশালায় তিনি বর্ণ পরিচয়ের পর নিজের নাম লিখতে রপ্ত করেন। পরে গৈলা গ্রামের বিখ্যাত পণ্ডিত মদনমোহন কবীন্দ্রের নিকট কলাপ ব্যাকরণের সন্ধিবৃত্তি হতে কারক প্রকরণের আরম্ভ পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেন। ঐ সময় এমন দিনও গেছে যে, দিনান্তে তাঁর পান্তা ফুরায়।

ত্রয়োদশবর্ষ গত হলে মাতা পুত্রের বিবাহ দিলেন। সেই বিবাহের পত্নী সতীশিবসুন্দরী। বিবাহের প্রায় ছয় বৎসর পরে চন্দ্রশেখরের মাতৃবিয়োগ ও পত্নী বিয়োগ হয়। উনবিংশ বৎসর বয়সে চন্দ্রশেখর পুনরায় দারপরিগ্রহ করেন ও পরে শ্বশুরালয় মাদারীপুর এসে বাস করেন। তাঁর দ্বিতীয়া পত্নী, সতীবিধুমুখী, মাদারীপুর নিবাসী শ্রীরামনারায়ণ পাঠকের জ্যেষ্ঠা কন্যা।

বিবাহের পর দিনই ‘শীতল’ ভাগবত নিয়ে পড়তে বসেন। ভাগবত খুলে দেখেন যে, ব্যাকরণ বোধ না হলে এক পদও অগ্রসর হবার নয়। বিক্রমপুরে তখন কেদার পদরত্ন নামে একজন প্রসিদ্ধ বৈয়াকরণ ছিলেন। তাঁর নিকট কয়েকমাস অধ্যয়ন করে, কলাপে তাঁর অদ্ভুত ব্যুৎপত্তি জন্মে। সেই সময় তিনি “বিদ্যাভূষণ” উপাধি প্রাপ্ত হন। বাড়ি ফিরে বিদ্যাভূষণ ব্যাকরণের টোল খুললেন ও সংস্কৃত ভাষায় বক্তৃতা আরম্ভ করলেন। নিরক্ষর শীতল কয়েক মাসেই পণ্ডিত হয়ে উঠলেন। যা দেখে সকলেই বিস্মিত হলেন। চন্দ্রশেখর ইতিপূর্বে ‘লক্ষ্মণ শক্তিশেল’ ও ঘোষযাত্রা’ নামক দুইখানি নাটক সংস্কৃতে রচনা করেন।

ব্যাকরণ শেষ করে কাব্য পড়তে তিনি হরিণাভির প্রসিদ্ধ পণ্ডিত রামনারায়ণ তর্করত্নের নিকট গমন করেন। কয়েক মাস মধ্যে কাব্য শাস্ত্রে পণ্ডিত হয়ে মাদারীপুরে প্রত্যাগমন করেন এবং কাব্য ও অলঙ্কার অধ্যাপনা করিতে থাকেন।

দর্শন শ্রাস্ত্র অধ্যয়নে চন্দ্রশেখরের প্রবল ইচ্ছা হয়। তখন তাঁর শ্বশুর রামনারায়ণ পাঠক এর সাহায্যে সাংখ্য বেদান্ত প্রভৃতি ষড় দর্শন অধ্যয়ন অভিলাষে তিনি কাশীধামে গমন করেন। তথায় কয়েক দিন পণ্ডিত সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রী ও দণ্ডী নারায়ণ শাস্ত্রীর নিকট দর্শণ পড়ে, এবং শ্রীহরিণাথ বেদান্তবাগীশের নিকট কয়েক মাস অধ্যয়ন করে দর্শন শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করেন ও “বেদান্ত ভূষণ” উপাধি প্রাপ্ত হন। সেই পাণ্ডিত্যের ফল “বেদান্ত বিজয়” ও “বেদান্ত রত্নাকর”।

কাশীধাম হতে ফিরে শীতলচন্দ্র বেদান্তভূষণ কিছু দিন কলকাতায় থেকে অধ্যাপনা করেন। কলকাতা হাইকোর্টের জজ স্বর্গীয় স্যার রমেশ চন্দ্র মিত্র, টাকীর জমিদার রায় শ্রীযতীন্দ্র নাথ চৌধুরী, এটর্ণি শ্রীহীরন্দ্র নাথ দত্ত, বাগবাজার নিবাসী জমিদার স্বর্গীয় রায় নন্দলাল বসু, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্রী শ্রীমতী সরলা দেবীর নিকট শ্রাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।

বেদান্তভূষণের মেধা যেমন অসাধারণ ছিল, তাঁর স্মৃতিশক্তিও সেইরূপ প্রখর ছিল। ব্যাকরণ হইতে বেদান্ত পর্যন্ত সমস্ত অধ্যয়ন, উল্লেখিত রূপে, সর্বসমেত দুই বৎসরের মধ্যে সমাধা হয়।

বাঁকীপুর হতে ফিরে বেদান্তভূষণ “বিবেকবিলাস” বা “সপ্তলোকাভিনয়” নামক একখানি বেদান্ত-নাটক রচনা করেন। সঙ্গে সঙ্গে বৈরাগ্যের প্রকটন হইতে থাকে। স্বর্গীয় পিতার স্মৃতির জন্য মাদারীপুরে “জগদ্বন্ধু সংস্কৃত কলেজ” স্থাপন করেন। ক্রমে কলেজে বহু ছাত্র সমাবেশ হল। কলেজের ব্যয় নির্বাহ কল্পে বেদান্ত প্রচার দ্বারা অর্থ সংগ্রহ করতেন।

উল্লেখ্য যে, মহাতীর্থ শ্রীবৃন্দাবনধাম লুপ্ত হয়েছিল। শ্রীচৈতন্য- দেবের আজ্ঞানুসারে শ্রীরূপসনাতন তা আবিষ্কৃত হয়। সে প্রায় ৫০০ বৎসর পূর্বের কথা। চন্দ্রনাথও মহাতীর্থ স্থান। শাস্ত্রমতে কলিতে তা তীর্থ হবে। সংস্কৃত রাজমালা অনুসারে প্রায় ৮০০ বৎসর পূর্বে চন্দ্রনাথও এক মহাতীর্থ বলে আবিষ্কৃত হয়। আশা করা যায় যে, এই মেধসাশ্রমও সেইরূপ প্রধান তীর্থ বলে প্রচারিত ও আদৃত ।

শ্রীমৎ বেদানন্দ স্বামী ছিলেন একজন জাতিস্মর যোগীপুরুষ ও পরিব্রাজক সন্ন্যাসী। ঘটনাচক্রে একদিন একটি পুর্দির একটি ছেড়া পাতা তাঁর হস্তগত হয়। ঐ পাতাটি পাঠ করে মর্ত্যলোকে দেবী দুর্গার প্রথম পূজাস্থল প্রাচীন মেধসমুনির আশ্রমের অবস্থান সম্পর্কে অবগত হন।

এরপরে প্রাচীন মেধস আশ্রমের অবস্থান আবিষ্কারের জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠেন। আশ্রম অবস্থান আবিষ্কারের উদ্দ্যেশ্য তিনি হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষ পরিভ্রমণ করেন। উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম ও মধ্যভারত তন্নতন্ত্র অনুসন্ধান শেষে তিনি পূর্ব ভারতের চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথধামে এসে উপনীত হন। চন্দ্রনাথ ধামে বসেই তিনি যোগবলে মেধস আশ্রমের সঠিক অবস্থান সর্ম্পকে ধারণা প্রাপ্ত হন।

৪০ বছর বয়সে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ ধামের মোহন্ত কিশোরী বন মহারাজ এর কাছে দীক্ষিত হয়ে শ্রী শংকর পরিবারের “বন্” সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে ও বেদানন্দ স্বামী হিসেবে উপাধি লাভ করেন।
সন্ন্যাস গ্রহণের পর চন্দ্রনাথ দর্শনে বেদানন্দকে পাহাড়ের অগ্নিকোণে দৃষ্টি নিবন্ধ করার আদেশ দিয়ে বলেন, ‘দেবীর আবির্ভাবস্থান মেধস আশ্রম পৌরাণিক শত সহস্র বছরের পবিত্র তীর্থভূমি। কালের আবর্তে সেই পীঠস্থান অবলুপ্ত হয়ে পড়েছে। তুমি স্বীয় সাধনাবলে দেবীতীর্থ পুনঃআবিষ্কার করে তার উন্নয়নে মনোনিবেশ কর। দেবী দশভূজা দুর্গা তোমার ইচ্ছ পূরণ করবে।
দৈববলে প্রভু চন্দ্রনাথের আদেশে বেদানন্দ স্বামী পাহাড়-পর্বত পরিভ্রমণ করে পবিত্র এ তীর্থভূমি মেধস আশ্রমে আবিষ্কার করেন।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ের সরাসরি অগ্নিকোণে চট্টগ্রাম শহর থেকে মাইল দশেকদূরে বোয়ালখালী থানার পূর্বপ্রান্তে করলডাঙ্গা পাহাড় অঞ্চলে এসে উপস্থিত হন। পুঁথিতে সমূহ পূঙ্গানুপুষ্পরূপে মিলিয়ে তিনি নিঃসন্দেহে হন যে, এটাই তাঁর বহু আকাঙ্ক্ষিত প্রাচীন মেধস আশ্রম অবস্থানের পূণ্যভূমি।

মেধস আশ্রম অনুসন্ধান ও আবিষ্কারের সময়ে তাঁর একান্ত সাথী ছিলেন কানুনগোপাড়া গ্রামের ‘অন্নদাচরণ সর্ববিদ্যা। মেধস আশ্রম আবিষ্কার কাল ১৯০০ খৃস্টাব্দ। ঐ সময়ে মেধস আশ্রমের সামনের বর্তমান কৃষি জমিগুলি ছিল অসংখ্য টিলা, ঢিবি ও ঘন ঝোপঝাড় ও বৃক্ষে আবৃত বনভূমি।

বর্তমান সীতা মন্দিরের স্থানটি ছিল ঘোর অরন্যে আচ্ছাদিত। বিরাট বিরাট মহীরুহের শাখা-প্রশাখা পত্রপুষ্প ভেদ করে ভূমিতে সূর্যালোকের প্রবেশ ছিল প্রায় দূর্ভেধ্য। দিনের বেলায় গাঢ় অন্ধকারে আবৃত স্থানটিতে ভয়ে গা ছমছম করত। বৃক্ষশাখায় সার্বক্ষনিক দেখা মিলত বানর-হনুমান, উল্লুক ইত্যাদি শাখা মৃগের। মাঝে মাঝে উঁকি দিত হরিনের পাল। অসংখ্য প্রাণীর আবাস ছিল স্থানটি। ছোট ঝরনার কুলকুল গান আর বৃক্ষশাখায় অসংখ্য পাখীর কিচিরমিচির ধ্বনিতে স্থানটি সব সময়ে মুখরিত থাকত।

বেদানন্দ স্বামীজী কর্তৃক মেধস আশ্রম স্থল আবিষ্কার কাহিনী অতিদ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ও আলোরণ সৃষ্টি হয়। তৎকালীন ভারতবর্ষের শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত, অভিজ্ঞ সরকারী কর্মকর্তাগণ, বিদগ্ধ ব্যক্তিবর্গ, প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, সাংবাদিক, গবেষক সহ নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষ সরেজমিনে স্থান পরিদর্শন ও পঙ্কানুপুঙ্করূপে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সকলেই এই স্থানকেই মেধস মুনির প্রাচীন আশ্রমস্থল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন।

আশ্রম সংলগ্ন ভূমির মালিক মহেন্দ্র ঘোষাল ও নীল কৃষ্ণ রায় প্রায় ৬৮ একরের অধিক ভূমি ও পাহাড় দশভূজা দেবীর নামে দানপত্র করে দেন। পাহাড় শীর্ষে ছন, বাঁশ ও টিন দিয়ে ঘর নির্মান করে দেবী পূজা শুরু হয়। প্রথম পূজারী নিযুক্ত হন কানুনগোপাড়া গ্রামের ‘গৌরীশংকর স্মৃতিতীর্থ ।

১৯০০ সালে মেধস আশ্রম আবিষ্কারের প্রথম দিন থেকে কানুনগোপাড়া গ্রামের অন্নদা চরন সর্ববিদ্যা তাঁর জীবনের শেষ দিন পঞ্চাশের দশকের শেষার্থ পর্যন্ত আশ্রমের দায়দায়িত্ব একাই বহন করেন।

১৯২০ সালে যুক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার
কাশিম বাজারের মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর অথানুকূল্যে শ্রী শ্রী চন্ডি মাতা মন্দির নির্মিত হয়। পরে ব্রহ্মদেশের ( মায়ানমার) সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তা যোগেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য এর সৌজন্যে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি সম্পূর্ণ পিতল নির্মিত দশভূজা দুর্গামূর্তি । যা’ ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দুষ্কৃতকারীরা গান পাউডার ব্যবহার করে মন্দিরের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে ও অন্যান্য সামগ্রীর সাথে পিতলের দেবী মূর্তিটি লুণ্ঠন করে নেয়। ১৯৮৭ সালে কানুনগো পাড়া গ্রামের সমাজসেবক হরিপদ কানুনগোর বদান্যতায় হাওলা গ্রামে শিল্পী প্রফুল্ল কুমার আচার্য কর্তৃক হস্ত নির্মিত দশভূজা দেবী দুর্গার এই পাষাণ প্রতিমাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যা প্রতিদিন এই দেবী মূর্তির বাৎসরিক পূজা নিরবিচ্ছিন্নভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলে বাইরে থেকে ভক্তদের আশ্রমে অনুদান প্রদান বন্ধ হয়ে যায়। এই সংকটময় মুহুর্তে ‘অন্নদা চরণ সর্ববিদ্যার সহযোগী কানুনগোপাড়া গ্রামের ‘বিজয় কৃষ্ণ চক্রবর্তী ও উত্তরভূর্ষি গ্রামের ‘অন্নদা চরণ চৌধুরী। তখন আশ্রম ছিল নিবিড় অরণ্যে আচ্ছাদিত।

১৯২০ সালে কাশিম বাজারের মহারাজা কর্তৃক শ্রীশ্রী দশভূজা মন্দির, অন্যদুই পাহাড় শীর্ষে একটিতে সারোয়াতলী গ্রামের ‘মুক্তাকেশী দেবী স্থাপিত মার্কণ্ডেয় শিব অন্যটিতে উত্তরভূর্ষি গ্রামের অন্নদা চরণ চৌধুরী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তারা দেবী দুটি ছোট ছোট টিনের ঘরে পূজিত হতেন । এগুলোও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সম্পূর্ণ ধবংস হয়ে যায়।

কথিত আছে ‘অন্নদা চরণ চৌধুরী দেবী মায়ের পূজার জন্য ৩০ আড়ি উপসত্বের ধান্যভূমি দান করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে গঠিত কমিটি ঐ জমির কোন হাদীস পায়নি।

আশ্রমের জন্য জীবন উৎসর্গীত ভক্ত বিজয় কৃষ্ণ চক্রবর্তী ও শ্রীমৎস্বামী নির্মলানন্দ গিরি মহারাজের অক্লান্ত উদ্যেগে চট্টগ্রাম শহরে ১৯৭৮ সালে একটি সভায় মেধস আশ্রম উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য সর্বপ্রথম একটি জন প্রতিনিধিত্ব মূলক কমিটি গঠিত হয়।

উক্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক অশ্বিনী কুমার বিশ্বাস শহর থেকে একাই ভক্তদের থেকে অনুদান সংগ্রহ করেছেন, নিজ তহবিল থেকে ব্যয় করেছেন অগনিত অর্থ, পরিকল্পনা করেছেন। কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক আমুচিয়া ইউনিয়নের বারংবার নির্বাচিত সদস্য শ্রী বিজয়কৃষ্ণ চক্রবর্তী ও অর্ধেক্য শ্রীমৎ স্বামী নির্মলানন্দ গিরি মহারাজ পাহাড়ে সার্বক্ষনিক অবস্থান করে মন্দিরের অনেক উন্নয়ন সাধন করেন।
তাদের চেষ্টা ও তত্বাবধানে পুরাতন মন্দির সংস্কারিত হয়ে নবরূপ পেয়েছে। দ্বিতল যাত্রী গৃহ, তিন কামরার পাকা ভোগঘর ও গোয়ালঘর, পাঁচ কামরার টয়লেট, দুইটি প্রবেশ তোরণ, অসংখ্য সিঁড়ি, পানীয় জলের পাকা পুকুর নতুন শিবমন্দির নির্মাণ, পাহাড় রক্ষার বেস্টনী প্রাচীর (বর্তমানে বিধ্বস্ত) ইত্যাদি বহুকাজ সম্পন্ন হয়।

উত্তর ভূর্ষি গ্রামের ‘ডাঃ যামিনী রঞ্জন চৌধুরীর সৌজন্যে নির্মিত হয় বেদানন্দজীর সমাধিগৃহ । প্রতিবৎসর ধূমধামের সাথে উত্তরায়ন সংক্রান্তি উৎসব অনুষ্ঠিত হত।

সিলেটের এক ভদ্রলোক জল উত্তোলনের জন্য বিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
শাকপুর গ্রামের শ্রী অমিত হোড় এর সৌজন্যে একটি নলকূপ সফলভাবে প্রোথিত হয়। অপর একজন দু’কিলোওয়াটের একটি জেনারেটর প্রদান করেন। স্বল্প শক্তির এই জেনারেটরের দ্বারা জল উত্তোলন ও আলোকদান সমস্যা হচ্ছিল বলে বর্তমানে ঢাকানিবাসী কেশিশহর গ্রামের শ্রী সুজিত চৌধুরী একটি পাঁচ কিলোওয়াটের জেনারেটর ও আশ্রমের সার্বক্ষনিক ব্যবহারের জন্য একটি মাইক কিনে দিয়েছেন।

আশ্রমের রাস্তার প্রবেশ মুখে করলডাঙ্গা গ্রামের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সুধীর দাশ ও তার ভাই উভয়ে মিলে দেড়লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে একটি সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণ করেন।

সাবেক সম্পাদক অশ্বিনী বাবুর জীবিত কালে
ঘাট থেকে মন্দির পর্যন্ত সমস্ত সিঁড়ি ও পাহাড়ের পাদদেশ থেকে মন্দির পর্যন্ত রাস্তার এক চতুর্থাংশ সিঁড়ি নির্মিত হয়েছিল । পরে ঐ রাস্তার সিঁড়ির কাজ প্রায় শেষ হয় অনেকের সহযোগিতায়।

“হরিপদ কানুনগোর প্রতিষ্ঠিত দশভূজা মূর্তিটি অবহেলায় মাটিতে পড়েছিল দীর্ঘদিন। পরে তাঁর পুত্র অজয় কানুনগোয় দেবীর বেদী নির্মান ও মন্দিরের অভ্যন্তরিণ সজ্জার জন্য দেড়লক্ষাধিক টাকার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং তারই উদ্যোগে সীতা দেবীর মন্দির নির্মান কাজ হয়।

জৈষ্ঠ্যপুরা গ্রামের অদুল চৌধুরী সৌজন্যে ১৫ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে আশ্রম এলাকায় নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র কামাক্ষ্যা মন্দির। প্রতিমা নির্মান করেন ভাস্কর শ্রী শ্যামল আচার্য্য। এই মন্দির ও কামাখ্যা দেবী মেধস আশ্রমের শুধু সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয় আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ। আশ্রম এলাকাকে
নানা মন্দির ও ভাষ্কর্যে সাজিয়ে মেধস আশ্রমেকে একটি তীর্থরূপে আকর্ষনীয় করে তুলে।

প্রথম পরিকল্পনা সীতা মন্দির, দ্বিতীয় পরিকল্পনা কামাখ্যা মন্দির, তৃতীয় পরিকল্পনায় একটি মেধস মুনির আশ্রম নির্মিত হয়।

 

কমিটির সাবেক সম্পাদক প্রয়াত অশ্বিনী বাবুর সুযোগ্য পুত্রগণ বিশেষ করে ডাঃ ওম প্রকাশ, ডাঃ শ্রী প্রকাশ, ইঞ্জিনিয়ার জয় প্রকাশ নিজ উদ্যোগে মেধস আশ্রম চত্বরে অম্বিনী বাবুর একটি স্মৃতি স্মারক নির্মাণ করেন। আশ্রম প্রাঙ্গণে নির্মিত হয় বিরাট নাট মন্দির। সমাধির উপরে নির্মলানন্দ মহারাজের, পাশে অশ্বিনী বাবুর স্মৃতিস্মারক নির্মিত হচ্ছে। দ্বিতীয় তলায় যাত্রী নিবাস ও অত্যাধুনিক টয়লেট নির্মাণের উন্নয়ন সাধন হয় তাদের অর্থায়নে।

পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রমের প্রবেশ পথে রয়েছে গণেশ মন্দির। ১৪০টি সিঁড়ি বেয়ে প্রায় ৫০০ ফুট উপরে রয়েছে মেধস মুনির মন্দির। ওই পথের আরও কয়েক ধাপ এগুলে দৃষ্টিনন্দন মূল আশ্রম। মূল আশ্রমেই রয়েছে চন্ডী মন্দির। চন্ডী মন্দিরের পাশে রয়েছে আশ্রমের আবিষ্কারক যোগী পুরুষ স্বামী বেদানন্দ মহারাজের সমাধি মন্দির। মূল আশ্রমের ডানে পাহাড়ি পথে কিছু দূর এগুলে চোখে পড়বে কামাক্ষ্যা মন্দির। তারপরের সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় শিব মন্দির। এরপর ওই পাহাড়ের আরও কয়েকধাপ নেমে আবারও ওঠতে হয় আরেকটি পাহাড়ের শীর্ষে। ওই পাহাড়ের শীর্ষে রয়েছে তারা কালি মন্দির। মূল আশ্রমে বামে পাশের একটি পাহাড়ে রয়েছে মেধসশ্বরী দক্ষিণা কালি মন্দির। মূল আশ্রম, কামাক্ষ্যা মন্দির, শিব মন্দির ও তারা কালি মন্দিরে পাহাড়ে সন্ধিস্থলে রয়েছে মানস সরোবর। পাহাড় নিসৃত ঝর্ণা ধারা এ সরোবরে প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হচ্ছে। মূল আশ্রম থেকে প্রায় ৩০০ ফুট নিচে এ সরোবর। তার পাশে রয়েছে সীতা মন্দির। জনশ্রুতি আছে ত্রেতাযুগে সীতা এ সরোবরে স্নান করেছিলেন। মূল চন্ডী মন্দিরের পেছনের অংশে রয়েছে ভোগঘর, আশ্রম অধ্যক্ষের কার্যালয়, যাত্রী নিবাস। এ ভোগঘরের সামনে কাঁঠাল গাছের গোড়ায় বিলুপ্ত প্রজাতির রয়েছে ১২টি কাছিম। এরা ঋষি কচ্ছপ নামে পরিচিত। ফুল বেলপাতা ও ফলের খোসা খেয়ে জীবনধারণ করে এ বিলুপ্ত প্রজাতির কাছিম। কথিত আছে মেধস ঋষির শাপে কোন এক ঋষি কাছিমে পরিণত হয়েছিলেন। আশ্রমের তত্ত্বাবধানে রয়েছে দুটি গাভী ও একটি হরিণ শাবক।
মন্দিরের প্রায় ৩০ জন লোক কর্মরত আছেন বলে মন্দিরের দায়িত্বে নিয়োজিত স্বরূপ চৌধুরী জানিয়েছেন।
শ্রীশ্রী চণ্ডী তীর্থ মেধস মুনি আশ্রম এর শ্রীমৎ বুলবুল আনন্দ মহারাজ বলেন এই আশ্রমের নামে ৬৮.১৯ একর ভূমি দেবত্তোর হিসেবে ছিল। কিন্তু আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী মহল শ্রী শ্রী চন্ডী তীর্থ ও মেধস মুনির আশ্রমের প্রায় ৫৫ একর ভূমি দখল করে নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন

সম্পৃক্ত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button