আরিফুর রহমান স্টাফ রিপোর্টার : ২০২৩ সালে উদ্বোধনের পর থেকে বন্ধ ছিল এটি। দীর্ঘ ৯ মাস বন্ধ থাকার পর সপ্তাহখানেক আগে মিউজিয়ামটি খুলে দেওয়া হয়েছে। জেলার ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য নির্মিত মিউজিয়ামটি সবার জন্য খুলে দেওয়ায় খুশি জেলাবাসী।
তবে এই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য কোনও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা মিউজিয়াম ছিল না। ফলে দিন দিন জেলা থেকে এগুলো হারিয়ে যেতে বসেছিল। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ইতিহাস সংরক্ষণে চালু করা হয়েছে মিউজিয়াম। কারণ অনাগত প্রজন্মকে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাস সংরক্ষণে জাদুঘর হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা প্রশাসনের মালিকানাধীন ঐতিহাসিক পুরোনো ট্রেজারি ভবনকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই ভবনের রয়েছে অনন্য অবদান। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো জেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়। যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্দেশ্যে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বেনজীর আহমেদ টিপু তার ‘মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর’ বইয়ের ১৬২-১৬৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখেন, ‘২৭ মার্চ থেকেই মাদারীপুর শহরে ছাত্র-যুবকদের নিয়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি।
প্রশিক্ষণের জন্য বিমান বাহিনীর সদস্য আলমগীর হোসাইন ও মতিয়ার রহমান হাওলাদার, সেনাবাহিনীর সুবেদার আব্দুল হকের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধারা থাকলেও প্রশিক্ষণের কোনও অস্ত্র ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াত। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ট্রেজারিতে রক্ষিত থ্রি নট থ্রি রাইফেলগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন। বীরমুক্তিযোদ্ধারা প্রতিদিন ট্রেজারি থেকে অস্ত্র নিয়ে যেতেন ও প্রশিক্ষণ শেষে পুনরায় ট্রেজারিতে অস্ত্র জমা রেখে যেতেন। এই উদ্যোগের ফলে জেলায় মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি সুসংগঠিত রূপে গড়ে ওঠে। জনসাধারণের মধ্যে প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। অচিরেই মহকুমা প্রশাসক সৈয়দ রেজাউল হায়াত ও মহকুমা ট্রেজারি ভবন মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে জেলা কালেক্টরেট আগের শকুনি লেকপাড় থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমান স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ট্রেজারি নতুন কালেক্টরেট ভবনে স্থানান্তরিত হয়। কালক্রমে ট্রেজারি ভবন ব্যবহার অনুপযোগী ও পরিত্যক্ত ভবনে রূপান্তরিত হয়। ভবনটির অবস্থান শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে, দৃষ্টিনন্দন শকুনি লেকপাড়ে। ফলে স্থানীয় দুর্বৃত্তচক্রের দৃষ্টি পড়ে। নামসর্বস্ব সংগঠনের নামে ট্রেজারি ভবন ও জমির একাংশ দখল হয়ে যায়। যা জাদুঘর স্থাপনের পর দখলমুক্ত হয়।
সার্বিক দিক-বিবেচনায় ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ শকুনি লেকপাড়ের পুরোনো ট্রেজারি ভবনে মিউজিয়াম উদ্বোধন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. শাজাহান খান এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে এর উদ্বোধন করেন। এ সময় জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিভিন্ন দফতরের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।
এরপরও মিউজিয়ামটি দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি। এমনকি খোলা হয়নি মূল ফটকও। এতে দীর্ঘদিন লতা-পাতার আড়ালে ছিল। জঙ্গলে ভরা ছিল মূল ফটক। সর্বশেষ জঙ্গল পরিষ্কার করে নতুনভাবে ‘মাদারীপুর মিউজিয়াম’ লেখা সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়। এক সপ্তাহ আগে সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার প্রতিদিন বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা রাখা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কয়েকজন মনীষীর ছবি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী, প্রাচীন ঐতিহ্য, পুরোনো ফ্যাক্স মেশিন, টাইপিং মেশিন, একুশে পদকপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেনের আঁকা বেশকিছু ছবিসহ পুরোনো কিছু জিনিসপত্র স্থান পেয়েছে মিউজিয়ামে।
এ ব্যাপারে মিউজিয়ামের কিউরেটর ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, জাদুঘরটিকে বর্তমান অবস্থানে আনতে জেলা প্রশাসনকে বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করতে হয়েছে। পুরোনো ট্রেজারি ভবনের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে ভবনটিকে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে। ট্রেজারি ভবন ব্যবহার অনুপযোগী ছিল। পরে ভবনটিকে সংস্কার করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়েছে। রাতের বেলায় জায়গাটিতে মাদকসেবীদের আড্ডা বসতো, তা বন্ধ করা হয়েছে। নিরাপত্তা দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়াসহ অন্যান্য কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। বর্তমানে জাদুঘরটি রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকছে। প্রবেশ সম্পূর্ণ ফ্রি।
জেলা প্রশাসক ও মিউজিয়ামের সভাপতি মোহাম্মদ মারুফুর রশিদ খান বলেন, জেলাসহ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে মাদারীপুর মিউজিয়াম। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী, মাদারীপুরের কৃতি সন্তান কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রায় শতাধিক দুর্লভ চিত্রকর্ম মিউজিয়ামের অনুকূলে উপহার হিসেবে সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে জেলার জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও সচেতন নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। মিউজিয়ামের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন ও অনুমোদন করা হয়েছে। ট্রাস্টি সদস্য হিসেবে প্রথিতযশা ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এটি জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভূমিকা রাখছে।