
সংগ্রাম দত্ত: সিলেট বিভাগের চারটি জেলার বিভিন্ন বনাঞ্চলের গাছপালা বনাঞ্চল উজাড়, বনের জায়গার দখল করে বসতি স্থাপন, রিসোর্ট , আনারস, লেবু, কাঁঠাল ও চা বাগান তৈরি করার কারণে বনাঞ্চলের ভূমির কম পরিমাণ দিন দিন কমছে। বন্যপ্রাণী সংখ্যাও আশঙ্কাজনক ভাবে কমেছে, কমছে। ফলে নানা কারণে বনাঞ্চল ও জলাশয়ে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায়
বন্যপ্রাণী ও জীবজন্তু নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। খাদ্যের সন্ধানে বন্যপ্রাণীরা লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে। ফলে বাড়িঘর শহরসহ লোকালয়ের বিভিন্ন স্থানে নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী ধরা পড়ছে। অনেক সময় আক্রান্ত হয়ে আহত ও মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে, ঘটছে।
সিলেটে বনবিভাগের প্রায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭১৪ একর জমির মধ্যে প্রায় ৫৮ হাজার একরই বেদখলে রয়েছে। নতুন করেও বেদখল হচ্ছে অনেক জমি। প্রায় এক তৃতীয়াংশ জমি বেদখলে থাকলেও তা উদ্ধারে বনবিভাগের তৎপরতা সামান্যই বলে দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড গত ১১ এপ্রিল ২০২১ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে ।
গত ২০ মে দুপুরে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বেপরোয়া মাইক্রোবাসের ধাক্কায় বিরল প্রজাতির মুখপোড়া হনুমানের বাচ্চাটি মারা যায়। মা হনুমান গুরুতর আহত হয়েছে।
সম্প্রতি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার “জুড়ী রেঞ্জ” এর লাঠিটিলা ও বড়লেখা রেঞ্জের মাধবকুন্ড ইকোপার্কে বিদ্যুৎপৃষ্ঠে গত ১বছরে ৭টি বিপন্ন প্রজাতির লজ্জাবতি বানর ও ৩টি চশমরাপরা হনুমানের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
১২ মে ২০২৫ মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের মূল ফটকের পাশে একটি প্রাপ্তবয়স্ক বানরের মৃত্যুসহ গত ৩১ মার্চ ২০২৫ ও ২৬ এপ্রিলে ২০২৫ আরও ২টি বানের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এদিকে লাঠিটিলা বন বিট এলাকায় এবছর আরও ৩টি ও বিনন্দপুর ১টি সহ মোট ৭টি লজ্জাবতি বানর ও লাঠিটিলা বনে আরও ৩টি চশমরাপরা মৃত্যু হয়। এভাবে প্রাণীরা মারা গেলে লাঠিটিলা ও মাধবকুন্ড বনে বন্যপ্রাণী শূণ্য হয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। পাশাপাশি জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে বলে ধারনা করছেন পরিবেশবাদী সেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো।
জানা যায়, মাধবকুন্ড ইকোপার্কের মূল ফটক সংলগ্ন প্রায় ৫ কি:মি: রাস্তার দুই পাশে লজ্জাবতী বানরের গুরুপুর্ণ আবাস্থল। সেখানে রাস্তার পাশ দিয়ে বিদ্যুতের যে খোলা তার গিয়েছে তাতে মাঝে মধ্যেই বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে মারা যাচ্ছে লজ্জাবতী বানর। বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠে জুড়ী – বড়লেখা মিলে বেশ কয়েকটি চশমাপরা হনুমান মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
২০২৩ সালে বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ বনের ভিতরের তারগুলো ইনসুলেটেড করার জন্য বিদ্যুৎ অফিসে আবেদন করা হলেও দীর্ঘদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও এযাবৎ কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
প্রতিনিয়ত যদি এভাবে হনুমানগুলো মারা যায়, তবে এই প্রাণীটি এই বনগুলোতে বিলুপ্তি হয়ে যাবে। যত দ্রুত সম্ভব এদের রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ।
লজ্জাবতি বানর হুমকির মূখে পড়ার অন্যতম কারণ হলো- নির্বিচারে বন উজাড়, পাচার, ঔষধ হিসাবে ব্যবহার, খাবারের উদ্দেশ্যে হত্যা ও বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে মারা যাওয়া লজ্জাবতী বানরের প্রধান হুমকী। এছাড়াও রাস্তার দুপাশের গাছের মধ্যকার ডাল (ক্যানোপী) কেটে সংযোগ নষ্ট হওয়ায় বাড়ছে রাস্তায় বানরের দুর্ঘটনার ঝুঁকি। এসব ঝুঁকি থেকে লজ্জাবতী বানর সহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের রক্ষা করতে । বনের মধ্যেকার বিদ্যুতের তারকে রাবার বা অন্যান্য বিদ্যুৎ অপরিবাহী কিছু দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হবে। একই সাথে রাস্তার দুই ধারের গাছের সংযোগ রক্ষা করতে হবে । বন সংরক্ষণে গাছ রোপণে লজ্জাবতী বানরের জন্য গাম বা আঠা উৎপাদনকারী গাছকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
গত ৮ এপ্রিল ২০২৩ দৈনিক সমকাল “বিদ্যুৎ স্পর্শে চশমা পড়া হনুমানের মৃত্যু” শীর্ষক এক প্রতিবেদনে লিখেছে যে ৭ এপ্রিল ২০২৩ রাতে জুড়ীর লাঠিছড়ার পাশের সড়কে একটি চশমা পরা হনুমান শাবককে হাউ মাউ করে কান্না করতে দেখেন স্থানীয়রা। এ সময় ছড়ায় একটি হনুমানকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরা মায়ের দুধ পান করে বেঁচে থাকে। মায়ের দুধ পান করতে না পারলে এ রকম ছোট শাবকগুলো বাঁচানো কঠিন। এরা মায়ের স্পর্শ ছাড়া বাঁচে না। একই স্থানে ১ অক্টোবর ২০২২ আরও একটি চশমা পরা হনুমানের মৃত্যু হয়। এরপর গত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বনের কাছে অবস্থিত দিলখোশ চা-বাগান এলাকায় সড়কের পাশে মৃত অবস্থায় একটি চশমা পরা হনুমান শাবক পাওয়া গিয়েছিল। সেটিরও মৃত্যু হয়েছিল বিদ্যুৎস্পর্শে। এভাবে একের পর এক হনুমানের মৃত্যু ঘটছে। এভাবে মরতে থাকলে বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীগুলো হারিয়েই যাবে।
সিলেট অঞ্চলে ১৯ মাসে ৫৭৬টি বন্য প্রাণী উদ্ধার করা প্রাণীর মধ্যে ৩৮০টি ছিল জীবিত, ১৯৬টি মৃত বলে গত ৩ মার্চ ২০২২ দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা প্রথম আলো “সিলেট অঞ্চলে ১৯ মাসে ৫৭৬টি বন্য প্রাণী উদ্ধার” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সিলেট টিলাগড় বন বিভাগের সংরক্ষণ কেন্দ্রের দুটি জেব্রা, পাঁচটি ময়ূর, ১১টি কই কার্প মাছ, চারটি খরগোশ মারা গেছে। এ কেন্দ্রে তিনটি ময়ূর, ২০টি হরিণ, অজগর, চার ধরনের পাখি, মাছ মিলিয়ে ৪৪টি বন্যপ্রাণী ঝুঁকিতে রয়েছে বলে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে জানা যায় ।
সিলেট বনবিভাগের লাউয়াছড়ার বনাঞ্চলের অভ্যন্তরে ট্রেনের গতিসীমা কমানো খুবই দরকার। প্রতিবছর দেখা যায় সাত-আটটি বড় প্রাণী ট্রেনে কাটা পড়ছে। বনের ভেতর মাত্র সাড়ে সাত কিলোমিটার জায়গা। কিন্তু ট্রেন এত দ্রুত যায়, বন প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। মানুষও দুর্ঘটনাকবলিত হয়। ট্রেনের গতি কমানোর বিষয়টি রেলপথ মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে বিবেচনাধীন আছে। সিদ্ধান্তটি অনুমোদন পেলে বিরল প্রাণীগুলো বেঁচে যাবে বলে বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর উদ্ধৃতি দিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা প্রথম আলো ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ “লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বন্য প্রাণী রক্ষায় কমছে ট্রেনের গতি” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
গত এক বছরে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও উদ্যান-সংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বিপন্ন প্রজাতির লজ্জাবতী বানর (Bengal Slow Loris), মুখপোড়া হনুমান (Capped Langur), চশমাপরা হনুমান (Phayer’s Langur)সহ প্রায় অর্ধ ডজন বন্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে। গত বছর ২০২১ সালের শুরু থেকে চলতি বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত মোট ৭টি মহাবিপন্ন, সংকটাপন্ন, বিপন্ন বন্যপ্রাণী বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি লাউয়াছড়া সংলগ্ন ফুলবাড়ি চা-বাগান এলাকায় একটি এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর এলাকায় একটি চশমাপরা হনুমান বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যায়। এছাড়াও ২০২১ সালের ৯ এপ্রিল গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এলাকায় একটি লজ্জাবতী বানার, ১৮ জুন রামনগর এলাকায় একটি চশমাপরা হনুমান, ১৬ জুলাই কালাছড়া বিট অফিসের সামনে একটি মুখপোড়া হনুমান, ২৪ জুলাই ভিক্টোরিয়া স্কুলের সামনে একটি বানর ও ১৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি বানরের মৃত্যু হয়েছে হয় বলে মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে ২৩ মার্চ ২০২২ “লাউয়াছড়ায় বৈদ্যুতিক তারে মারা পড়ছে ‘মহাবিপন্ন’ বন্যপ্রাণী” শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বাংলা নিউজ ২৪.কম এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের পাশে হাতিমারা চা বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের ইজারা নেওয়া জমিতে বাগান সম্প্রসারণের জন্য গাছ কেটে আগুন ধরিয়ে দেয়ায় আগুনে পুড়েছে হনুমান, মায়াহরিণ, বিরল প্রজাতির কাঠবিড়ালি ও পাখিসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জায়গাটি মায়া হরিণের পছন্দের জায়গা। এখানে থাকা আউলা নামের একটি গাছের ফল মায়া হরিণ খায়। এই আউলা গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাচীণ ১৪০টি গাছ কেটে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ায় বানর, হনুমান, মায়াহরিণ, শূকরসহ নানা প্রজাতির অনেক প্রাণী আশ্রয় হারিয়েছে। অনেক প্রাণী পুড়ে মারা গেছে
গত ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ “পুড়িয়ে মারা হলো শত প্রাণ”
এক প্রতিবেদনে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রিন্ট মিডিয়া দি ডেইলি স্টার একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে।
একশ্রেণীর প্রভাব প্রতিপত্তিশালী গোষ্ঠী সঙ্ঘবদ্ধভাবে
বনাঞ্চল দখল করে বসতি স্থাপন, রিসোর্ট ও চা বাগান তৈরি, বনজ সম্পদ ধ্বংস করার কারণে বন্যপ্রাণীরে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় বন্যপ্রাণী খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে ছুটি আসছে। অনেক সময় মানুষের হাতে বা সড়কে গাড়ির চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বেশিরভাগই মানুষের হাতে ধরা পড়ছে।
শ্রীমঙ্গল থানার বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে বাসা বাড়িতে, ক্ষেতের ফসলে, মাঠে ও ঝোপঝাড়ে বিষাক্ত সাপসহ বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রাণী ধরা পড়ার খবর পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশন- শ্রীমঙ্গল দীর্ঘ দেড় যুগের উপর শ্রীমঙ্গল উপজেলা ও তার আশপাশ এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন রকমের প্রায় সাত শতাধিকের উপরে বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে স্থানীয় বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করেছে বলে জানা গেছে