শুল্ককর না দিয়েই রোলস রয়েস পার করলেন অনন্ত গ্রুপের শরিফ জহীর

নিজস্ব প্রতিবেদক: শুল্কায়ন ছাড়াই খালাস নেয়া হয়েছে বিশ্বখ্যাত ব্যান্ডের গাড়ি ‘রোলস রয়েস’। কাঁচামালের সঙ্গে এ গাড়ি নেয়া হয় চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (সিইডিজেড)। সেখান থেকে লুকিয়ে গাড়িটি আনা হয় ঢাকার বারিধারায়। ৭০ দিন আগে বন্দর থেকে খালাস নেয়া হলেও শুল্কায়ন সম্পন্ন করা হয়নি। মূলত শুল্ককর ফাঁকি দিতেই গাড়িটি লুকিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। বিলাসবহুল এ গাড়িটিতে নজর রেখে শেষ পর্যন্ত দেশের নামি এক ব্যবসায়ীর বাস ভবনের গ্যারেজ থেকে জব্দ করেছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ওই ব্যবসায়ীর নাম শরিফ জহীর। তিনি বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক এবং পোশাক খাতের স্বনামধন্য অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গতকাল গাড়িটি জব্দ করা হয়। কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, গাড়িটি জব্দ করতে না পারলে প্রায় ২৪ কোটি টাকার রাজস্ব হারাতো সরকার।

কাস্টমস গোয়েন্দার যুগ্ম পরিচালক মো. শামসুল আরেফিন খান জানিয়েছেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে আমরা জানতে পারি, চট্টগ্রাম ইপিজেডের জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেড একটি প্রতিষ্ঠান ৬ হাজার ৭৫০ সিসির কলিনান এসইউভি মডেলের বিলাসবহুল রোলস রয়েস আমদানি করেছে। স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল ধরনের গাড়িটির আমদানির জন্য মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে এলসি খোলা হয়। ২৭ এপ্রিল বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে গাড়িটি যুক্তরাজ্যের ভারটেক্স অটো লিমিটেড থেকে গাড়িটি আমদানি করা হয়েছে। গাড়িটি শুল্কায়ন ছাড়াই খালাস নেয়া হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয় কাস্টমস গোয়েন্দা। আমদানি নথিতে গাড়ির মূল্য দেখানো হয়েছে দুই লাখ পাউন্ড।

যাতে দেখা যায়, গাড়িটি বন্দর থেকে স্কট করে জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ৪ জুলাই পর্যন্ত অর্থাৎ খালাসের ৭০ দিন পরও শুল্কায়ন কার্যক্রম শেষ করা হয়নি। কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা গোপনে জানতে পারেন, কাস্টমসকে অবহিত না করেই ১৭ মে রাতে চট্টগ্রাম ইপিজেড থেকে অবৈধভাবে অপসারণ করা হয়েছে। বেআইনিভাবে অপসারণ করা গাড়িটির অবস্থান শনাক্ত করা হয়। যাতে দেখা যায়, গাড়িটি চট্টগ্রাম থেকে বারিধারায় ওই কোম্পানির (জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহীরের বাসার গ্যারেজে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। পরে কাস্টমস গোয়েন্দার একটি দল গাড়িটি গ্যারেজ থেকে জব্দ করেন।

মো. শামসুল আরেফিন খান আরও জানান, গাড়িটি সিপিসি ১৭০ এর সুবিধায় শুল্কমুক্ত আমদানি করা হয়েছে। যদিও সিপিসি ১৭০ অনুযায়ী ২০০০ সিসি পর্যন্ত কার আমদানির জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রযোজ্য হবে। তবে গাড়ির আমদানি কাগজপত্র ও জব্দ করা বিলাসবহুল গাড়িটির বনেটে থাকা স্টিকার অনুযায়ী, রোলস রয়েস গাড়িটি ৬ হাজার ৭৫০ সিসির। সিপিসি অনুযায়ী গাড়িটি শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবেন না। বিলাসবহুল গাড়িতে আমদানি শুল্ককর ৮৫০ শতাংশ। গাড়িটি শুল্কমুক্ত সুবিধা না পেলে শুল্ককর দিতে হবে প্রায় ২৪ কোটি টাকা। আমদানিকারক গাড়ির মূল্য ঘোষণা দেয়া হয়েছে ২ লাখ পাউন্ড, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২ কোটি ২২ লাখ টাকা। শুল্ককরসহ গাড়ির মূল্য প্রায় ২৭ কোটি টাকা। গাড়িটি জব্দ না হলে সরকার এ শুল্ককর থেকে বঞ্চিত হতো। গাড়িটি শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে কি না-তা খতিয়ে দেখতে কাস্টমসকে অনুরোধ জানানো হবে। আমদানিকারক বেআইনিভাবে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া না করেই গাড়িটি গ্যারেজে লুকিয়ে রেখে শুল্ক আইনের বিধান ভঙ্গ করেছেন। এ ক্ষেত্রে চোরাচালান হিসেবে গণ্য হওয়ার অপরাধ হয়েছে। জব্দ করা গাড়িটি ঢাকা কাস্টম হাউসের শুল্ক গুদামে জমা দেয়া হয়েছে।

আমদানি অনুমতি (ইমপোর্ট পারমিট) পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জেড অ্যান্ড জেড ইনটিমেটস লিমিটেড হংকং এবং বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত। এটি পোশাক খাতের অনন্ত গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান (কৌশলগত বাণিজ্যিক অংশীদার বা এসবিইউ)।

কোম্পানির তথ্যানুযায়ী, এ কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ জহীর। কোম্পানিতে তার শেয়ার ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন শওকত আলী চৌধুরী। তার মালিকানা শেয়ার ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এছাড়া পরিচালক হিসেবে রয়েছেন তাসলিমা আম্বারিন ও আসিফ জহীর। কোম্পানিতে দুইজনের শেয়ার রয়েছে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ করে। আসিফ জহীর অনন্ত গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শ্রীলঙ্কার নাগরিক লিপেরুমা বাচ্চিজি কোম্পানির পার্টনার হিসেবে রয়েছেন, যার মালিকানা রয়েছে ১০ শতাংশ।

এ বিষয়ে  শরিফ জহীর  বলেন, বেপজার নিয়ম অনুযায়ী, যারা ২০০৯ সালের আগে ফ্যাক্টরি স্থাপন করেছেন, তারা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে পারবেন। আমার ফ্যাক্টরি ২০০৯ সালের আগে প্রতিষ্ঠিত। বিনিয়োগ ১৮ মিলিয়ন ডলার। নিয়ম অনুযায়ী ৫ মিলিয়ন বিনিয়োগ হলেই গাড়ি আমদানি করতে পারবেন। বেপজার অনুমতি নিয়ে, সব নিয়ম মেনেই গাড়ি আমদানি করা হয়েছে। অ্যাসেসমেন্ট প্রক্রিয়া চলমান থাকা অবস্থায় গাড়ি জব্দ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম  বলেন, অ্যাসেসমেন্ট চলমান অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে আমাদের না জানিয়ে গাড়িটি ইপিজেড থেকে বের করা হয়েছে। কাস্টমস গোয়েন্দা জব্দ করেছে, তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, গাড়িটি শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা হয়েছে বলে বিল অব এন্ট্রি ও অন্যান্য কাগজপত্র দাখিল করা হয়েছে। এসআরও এর শর্ত ও আইপি এর সঠিকতা যাচাইয়ে সময় লাগছে। সময় লাগতে পারে। কিন্তু আমদানিকারক আমাদের থেকে অনুমতি না নিয়ে এবং অ্যাসেসমেন্ট সম্পন্ন না করেই গাড়ি ইপিজেড থেকে বের করে নিয়ে গেছেন।

সম্পৃক্ত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button