
ইতিহাসের এক অদ্ভুত পুনরাবৃত্তি আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করি—যে যখন লঙ্কায় যায়, সেই-ই যেন রাবণ হয়ে যায়। ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যিনি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জ্বালামুখের মতো উচ্চারণ করতেন, ক্ষমতার আসনে বসেই যেন তিনি হয়ে যান সেই স্বৈরতন্ত্রের প্রতিমূর্তি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে এর বহু উদাহরণ আছে। একসময় আমরা গলা ফাটিয়ে বলেছি—“স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।” আন্দোলন ও রক্তের বিনিময়ে গণতন্ত্র এলেও, অল্প কিছু বছরের মধ্যেই সেই গণতন্ত্র গুটিয়ে এসে দলীয় একনায়কতন্ত্রে রূপ নিল। কয়েক বছর পর আবার উত্তাল জনরোষ, রাজপথে লগি-বৈঠা, নিরীহ মানুষের মৃত্যু, এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ক্ষমতার সিংহাসনে নতুন মুখ। কিছুদিন পরেই সেই নতুন মুখকেই ফ্যাসিবাদী আখ্যা দিয়ে বিদায় করার জন্য আবার আন্দোলন। দোষ কার? শাসকের দোষ অনস্বীকার্য—তারা ক্ষমতায় গিয়ে জনগণকে ভুলে যান, দলীয় স্বার্থকে জাতির স্বার্থের ওপরে তোলেন, আর আশেপাশের চাটুকার ও দুর্নীতিবাজরা এই স্বৈরতান্ত্রিক রূপকে পোক্ত করে তোলে। কিন্তু একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মূল দায়ের অংশীদার জনগণও বটে। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি জনগণ—কিন্তু যখন সেই জনগণ— 1. ভোট বিক্রি করে ৫০০ টাকা, একটি শাড়ি বা একটি ভোজের বিনিময়ে, 2. যোগ্যতার বদলে জাতপাত, গোষ্ঠী বা দলীয় আনুগত্যে নেতা বেছে নেয়, 3. দুর্নীতি দেখে চুপ থাকে বা সুযোগ পেলে নিজেরাও করে, 4. রাজনৈতিক সহিংসতাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়— তখন গণতন্ত্র টিকেই বা কীভাবে? ক্ষমতার মনস্তত্ত্ব ক্ষমতা মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনে— ক্ষমতায় গেলে সাধারণ মানুষের কষ্ট ও বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। আশেপাশের চাটুকারদের প্রশংসা ও তোষামোদে নীতি ভঙ্গ হয়। পদ রক্ষাই হয়ে ওঠে প্রধান লক্ষ্য, জনগণের সেবা নয়। ফলে, যে মানুষটি একসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তেন, তিনিই হয়ে ওঠেন সেই অন্যায়ের রক্ষক। গণতন্ত্রের চক্র বাংলাদেশের রাজনীতিতে চক্রটি প্রায় অভিন্ন— 1. স্বৈরাচার পতন। 2. গণতন্ত্রের আগমন। 3. কয়েক বছরের মধ্যে দুর্নীতি ও একনায়কতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। 4. জনরোষ ও আন্দোলন। 5. নতুন ক্ষমতাধারীর আবির্ভাব, যিনি পরবর্তীতে একই রকম হয়ে ওঠেন। যতদিন পর্যন্ত জনগণ নিজেদের রাজনৈতিক, নৈতিক ও সামাজিক চরিত্র পরিবর্তন না করবে, এই চক্র চলতেই থাকবে। সমাধান গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে মুক্তি পাবে তখনই যখন— 1. মানসম্মত শিক্ষা নাগরিককে সচেতন ও নৈতিক করে তুলবে। 2. ভোট কেনা-বেচা সামাজিকভাবে লজ্জাকর অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। 3. রাজনৈতিক সংস্কৃতি দলকেন্দ্রিকতা থেকে রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতায় রূপ নেবে। 4. জনগণ নিজে দৈনন্দিন জীবনে সততা ও নৈতিকতা চর্চা করবে। গণতন্ত্র কেবল একটি শাসনব্যবস্থা নয়; এটি একটি সংস্কৃতি, যা জনগণ ও নেতৃত্ব—দু’পক্ষের যৌথ দায়িত্বে টিকে থাকে। যতদিন আমরা বিবেকহীন ও লোভী জাতি হয়ে থাকব, ততদিন ক্ষমতার রাবণরা শুধু বদলাবে, কিন্তু রাবণতন্ত্র শেষ হবে না।




