
হ্লাথোয়াইছা চাক, রাবি প্রতিনিধি : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালিত হয়েছে। আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভবিষ্যৎ গঠনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সার্থক প্রয়োগ—এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে শনিবার (৯ আগস্ট) আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জুম্ম শিক্ষার্থী পরিবার; বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংসদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রাজশাহী মহানগর শাখা এবং আদিবাসী স্টুডেন্টস এ্যাসোসিয়েশন অব রাজশাহী ইউনিভার্সিটি এর সম্মিলিত উদ্যোগে ক্যাম্পাসে বর্ণাঢ্য র্যালি আয়োজন করা হয়।
র্যালিটি ক্যাম্পাসে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে প্রদক্ষিণ করে টিএসসিসিতে এসে সম্পন্ন হয়।
এরপর আলোচনা সভা এবং ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সিনিয়র শিক্ষার্থী তন্ময় তঞ্চঙ্গ্যা এর সভাপতিত্বে এবং বিজয় চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি সঞ্চালনায় আলোচনায় সভায় প্রধান অতিথি ড. মো: আমিরুল ইসলাম ছাত্র উপদেষ্টা, বিশেষ অতিথি জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুভাস চন্দ্র হেমব্রোম সহ আরও অনেকে প্রোগ্রামে উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ছাত্র উপদেষ্টা ড. মো. আমিরুল ইসলাম বলেন,
“পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছাত্রজীবন থেকেই আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।”
তিনি বাংলাদেশের আদিবাসীদের অবস্থা বিভিন্ন দেশের আদিবাসীদের সঙ্গে তুলনা করে বিশ্লেষণ করেন। বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেন, রাষ্ট্র কর্তৃক দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসীদের ভূমি দখল এবং ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতির মাধ্যমে বিভেদ সৃষ্টির ইতিহাস রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যেখানে পর্যটনের সুফল আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজে লাগছে না, সেখানে এমন পর্যটনের প্রয়োজন নেই।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের আদিবাসীদের মাঝে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে ভূমি অধিকারের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন অপরিহার্য।
এছাড়া, আদিবাসী সংস্কৃতি সংরক্ষণের জন্য নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা, ধর্ম ও ঐতিহ্য রক্ষা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। বক্তব্যের শেষে তিনি আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে আদিবাসীদের সার্বিক উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
আদিবাসী স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব রাজশাহী ইউনিভার্সিটির সাধারণ সম্পাদক প্রিন্স হেমন্ত টুডু বলেন,
“আদিবাসী সমমনা সকল সংগঠনের সাথে একসাথে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। প্রতি বছর এই বিশেষ দিনটি আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে স্মরণ এবং ধারণ করার সুযোগ এনে দেয়।
আজকের আলোচনা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি, আমাদের নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-এর ভূমিকা নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করেছে। আমরা যদি প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে উন্নতি করি, তবে পরিবার, সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। একইসাথে, আমরা সোনার বাংলাদেশের গর্বিত আদিবাসী হিসেবে নিজেদের যোগ্য ও মর্যাদাবান নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারব।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ রাজশাহী মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক সুমন চাকমা বলেন—
“আদিবাসী পরিচয় দিতে গেলে অনেকে ‘অধিবাসী’ শব্দটিকে সামনে নিয়ে আসে। অথচ তারা বোঝে না— ‘আদিবাসী’ মানে শুধু বাসিন্দা নয়। বরং আদিবাসী বলতে বোঝায় সেই জনগোষ্ঠী, যারা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্রোতের বিপরীতে থেকেও মাটি ও প্রকৃতির সাথে গভীরভাবে যুক্ত, এবং যাদের রয়েছে নিজস্ব মাতৃভাষা, পোশাক ও ঐতিহ্য।
ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুযায়ী, ১৮০০ শতকের পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো স্থায়ী বাঙালি ছিল না। পাহাড়ের মানুষ তখন জুমচাষে অভ্যস্ত ছিল, কৃষিকাজের জন্য সমতল থেকে কিছু বাঙালিকে আনা হয়। তারাই মূলত পাহাড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে।
১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে লক্ষাধিক পাহাড়ি জনগণ ভারতে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরও আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিয়ে ‘বাঙালি’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়। ১৯৭৮-৮৩ সাল এবং পরবর্তী সময়ে বিপুল সংখ্যক সেটেলার বাঙালিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করা হয়। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতির অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বিভিন্ন দল ও উপদল সৃষ্টি করা হয়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীরব ভূমিকার ফলে এবং জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ১৭, ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলায় জুনান, ধনঞ্জয় ও অনিক নিহত হন।
তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নিম্নলিখিত দাবিগুলো উপস্থাপন করেন—
১. জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর এবং আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান।
২. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান এবং পাঠ্যপুস্তকে মাতৃভাষা অন্তর্ভুক্তকরণ।
৩. বাদ পড়া সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সরকারি গেজেটে অন্তর্ভুক্তকরণ।
৪. আদিবাসীদের ভূমি বেদখল বন্ধ, ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং পৃথক ভূমি কমিশন গঠন।
৫. পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সঠিক ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্ত করা।
৬. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন।
৭. সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন।
৮. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সংঘটিত ধর্ষণের বিচার ও নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৯. কারাগারে অন্তরীণ নিরপরাধ আদিবাসী বম জনগোষ্ঠীর লোকদের নিঃশর্ত মুক্তি।
১০. পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের আদিবাসীদের ঐতিহ্য ও প্রথাগত ভূমি অধিকার নিশ্চিতকরণ।
এছাড়া, অনুষ্ঠানে সংহতি প্রকাশ করে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুভাস চন্দ্র হেমব্রোম বলেন,
“সমতল অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাকরাম মাঝি, সিধু, কানু এবং পাহাড়ি নেতা এমএন লারমার প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
সারা বিশ্বের আদিবাসীদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
আমি বুঝতে পারি না—কেন এই স্বাধীন ভূখণ্ডে বসবাসরত ৫০টিরও বেশি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে মুছে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়,
কেন তাদের স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্র অনীহা প্রকাশ করে।
আমরা চাই, আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার নিশ্চিত হোক।”
এবং আদিবাসী ছাত্র পরিষদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সঞ্জয় কুমার ওঁরাও বক্তব্যে বলেন, অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাতে হয় যে, বাংলাদেশে আমরাই আদিবাসী অথচ আমাদের আত্মপরিচয়ের জন্য আজো লড়াই করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এআই এর ভালো-খারাপ প্রভাব রয়েছে৷ মাঝে মধ্যে আমরা এআই এ আদিবাসী বিষয়ক ভুল তথ্য দেখতে পাই। তবে আমরা ভালো দিকগুলোই দেখব। যেমন নিউজিল্যান্ডের মাওরি আদিবাসীরা এআই দ্বারা তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় বর্ণ তৈরি করে দিয়েছে। সিপাহি বিদ্রোহ, সাওতাল বিদ্রোহে আদিবাসীদের অবদানের কথা তুলে ধরেন।
দিনব্যাপী কর্মসূচিতে র্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে আদিবাসী দিবস উদযাপন শেষ হয়। বক্তারা আশা প্রকাশ করেন—আদিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সমাজ ও রাষ্ট্র এগিয়ে আসবে।