
মাহবুব আলম: “যার ভুল, তার মাশুল তাকেই দিতে হয়”—এটি কেবল কথার কথা নয়, বরং ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা। রাজনীতির মঞ্চে বারবার আমরা দেখেছি—বিশ্বাসঘাতকতা, অন্তর্ঘাত, ও মুখোশধারী দালালদের কারণে ধ্বংস হয়েছে নেতৃত্ব, বিপথে গেছে দল, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাষ্ট্র। আজকের বাংলাদেশেও আমরা সেই ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা প্রত্যক্ষ করছি।
বঙ্গবন্ধুর করুণ পরিণতি: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি একাত্তরের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত নিজের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে বাঙালির মুক্তির জন্য নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইয়াহিয়া খান বা জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁকে কারাগারে বন্দি করলেও তাঁকে হত্যা করতে পারেনি। অথচ, স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায়—১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট—এই বাঙালিরাই তাঁকে হত্যা করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ঘাতকরা ছিল তাঁরই আপনজন, তাঁরই কাছের লোকজন। এই বিশ্বাসঘাতকতার দায় পুরো জাতিকেই দীর্ঘদিন বহন করতে হয়েছে।
শহীদ জিয়াউর রহমানের বেলায়ও একই রকম নাটক মঞ্চস্থ্যত হতে দেখেছি! একই পরিণতি ভোগ করেছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আরও অধিক লোভের জন্য তাঁর ঘনিষ্ট জনেরাই নেতৃত্ব দিয়েছিল জিয়াউর রহমানকে হত্যার মিশনে। রাজনীতিতে বিশ্বাস ও আনুগত্যের যে বোধ থাকা দরকার, সেখানে সুবিধাবাদ ও ষড়যন্ত্রই ছিল মুখ্য।
‘৯০ পরবর্তী সময় ও রূপ বদলের রাজনীতি: ১৯৯০-এর পর বেগম খালেদা জিয়া যখন রাজনৈতিক নেতৃত্বে, তখন বিএনপি হয়ে উঠেছিল জনগণের বৃহৎ অংশের পরিচিতি। ৯৯% মানুষ বিএনপির নাম করে নিজেকে পরিচয় দিত। কিন্তু যখন সেনা সমর্থিত সরকারের আবির্ভাব ঘটল, তখনই অধিকাংশ নেতা কর্মীই রঙ বদলে ফেলল—প্রকৃত নেতাকর্মীদের পিএনপি ‘র থেকে দূরে রেখে মুখোশধারীরাই হয়ে উঠল দলীয় মুখ। সেখানেও প্রতারণার ইতিহাস যেন পুনরাবৃত্তি করল।
আওয়ামী লীগের ২০০৮ পরবর্তী বাস্তবতা: ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যখন পুনরায় ক্ষমতায় আসে, তখন অনেকেই ‘আওয়ামী লীগ সেজে’ ক্ষমতার চূড়ায় উঠতে শুরু করে। আদর্শিক কর্মীদের আওয়ামী থেকে দূরে রেখে, সুবিধাভোগীরা দলে প্রভাব বিস্তার করে দুর্নীতির সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। ফলত, আজ আওয়ামী লীগকেও সেই অপকর্মের মাশুল দিতে হচ্ছে।
উপসংহার: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস একটি বিষাদের দীর্ঘ পাণ্ডুলিপি, যেখানে মুখোশধারী আপনজনদের বিশ্বাসঘাতকতায় রচিত হয়েছে রক্তাক্ত অধ্যায়। “মায়ের চেয়ে বেশি দরদ দেখায় যারা, ইতিহাসে দেখা গেছে তারাই ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ডাইনী।” এই শিক্ষাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। রাজনৈতিক দলগুলো যদি প্রকৃত অর্থে নিজেদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করে, আদর্শিক নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করে, এবং মুখোশধারী সুবিধাভোগীদের প্রতিরোধ করতে পারে—তবেই এ দেশ একদিন অপরাজনীতি মুক্ত হবে।