ফরিদপুর জেলার কুমার নদীর পানির গুণমান মূল্যায়ন: বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ফরিদপুর থেকে ফৌজিয়া আক্তার: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলধারা ফরিদপুর জেলার ‘কুমার নদ’। সম্প্রতি নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট (নগই), ফরিদপুর-এর উদ্যোগে এবং মাননীয় উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান-এর নির্দেশনায় নদীটির পানির গুণমান নিয়ে একটি বিশেষ গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হয়। “Assessment of Water Quality of the Kumar River in Faridpur District Using the Water Quality Index” শীর্ষক এই গবেষণায় নদীর বর্তমান অবস্থা, দূষণের মাত্রা এবং ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। গত ২৮ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে এক সেমিনারের মাধ্যমে এই গবেষণার ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।

পদ্মা নদীর একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে কুমার নদের উৎপত্তি। ৭৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং গড় ৪৪ মিটার প্রস্থের এই নদীটি ফরিদপুর শহরের বুক চিরে প্রবাহিত হয়ে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর দিয়ে মাদারীপুরের বিলরুট নদীতে পতিত হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১১ নম্বর নদী হিসেবে চিহ্নিত কুমার নদ ঐতিহাসিকভাবে কৃষি, মৎস্য শিকার, নৌ-পরিবহন এবং স্থানীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। নদীটি ফরিদপুর শহরকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে এবং শহরের পানি নিষ্কাশন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

একসময়ের খরস্রোতা কুমার নদ বর্তমানে নানামুখী সংকটের মুখে। ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে উজানের প্রবাহ হ্রাস, নদীর তীর দখল, অপরিকল্পিত বর্জ্য নিক্ষেপ এবং শিল্প ও কৃষিজ দূষণের কারণে নদীটি তার নাব্যতা ও জৌলুস হারাচ্ছে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দূষণের ঘনত্ব বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০২৫ সালের মে ও জুন মাসে কুমার নদের ৪৫ কিলোমিটার অংশজুড়ে গবেষণাটি পরিচালনা করে। বালিয়াঘাট (S1) থেকে ভাঙ্গা (S12) পর্যন্ত মোট ১২টি স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গবেষণায় পানির ভৌত-রাসায়নিক উপাদান (pH, EC, DO, TDS, Turbidity) এবং ভারী ধাতুর (আর্সেনিক, সীসা, ক্যাডমিয়াম ইত্যাদি) উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। পাশাপাশি Water Quality Index (WQI) এবং বিভিন্ন দূষণ সূচক (HPI, HEI, Cd, NPI, ERI) ব্যবহার করে সামগ্রিক মান বিশ্লেষণ করা হয়।


গবেষণার মূল ফলাফল:
১. পানির মান: গবেষণায় দেখা গেছে, কুমার নদীর অধিকাংশ স্থানের পানির মান “চমৎকার” থেকে “ভালো” পর্যায়ে রয়েছে।
২. দূষণ প্রবণ এলাকা (Hotspots): রথখোলা সেতু (S7) এলাকায় পানির মান কেবল “নিরাপদ” পর্যায়ে রয়েছে। অন্যদিকে, আলিপুর সেতু (S6) এবং ভাঙ্গা (S12) এলাকায় ক্যাডমিয়াম (Cd) ও সীসা (Pb)-এর দূষণ তুলনামূলক বেশি পরিলক্ষিত হয়েছে।
৩. ভবিষ্যৎ ঝুঁকি: বর্তমানে ভারী ধাতুর দূষণ আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য সীমার মধ্যে থাকলেও, শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে গেলে এই দূষণ বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে বলে গবেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সুপারিশমালা ও করণীয়:
গবেষণাপত্রে নদী রক্ষায় চারটি প্রধান সুপারিশ করা হয়েছে:
লক্ষ্যযুক্ত পর্যবেক্ষণ: অধিক দূষিত স্থানগুলোতে (S6, S7, S12) নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ: শিল্প বর্জ্য ও কৃষিজ রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ।
জনসচেতনতা: বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নদী সংরক্ষণে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করা।
অবকাঠামো উন্নয়ন: পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
পর্যটন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা:
কুমার নদকে কেন্দ্র করে ফরিদপুরে ইকো-ট্যুরিজম গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনা রয়েছে। নদীর তীর ঘেঁষে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, নৌ-ভ্রমণ, এবং স্থানীয় পণ্যের বাজার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করা গেলে তা স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এটি একইসাথে নদী সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়নের একটি মডেল হতে পারে।
উপসংহার:
গবেষণার সার্বিক ফলাফলে প্রতীয়মান হয় যে, কুমার নদের পানি এখনও কৃষি ও গৃহস্থালি কাজের জন্য উপযোগী। তবে দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই নদীটি বড় হুমকির কারণ হতে পারে। জেলা প্রশাসন, পৌরসভা এবং স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কুমার নদ তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে এবং ফরিদপুরবাসীর জন্য আশীর্বাদ হিসেবে টিকে থাকতে পারে।
গবেষকবৃন্দ ও তত্ত্বাবধায়ক:
ড. মো. আলাউদ্দীন হোসেন, পরিচালক, জিঃ আরঃ, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট (নগই), ফরিদপুর।
মো. দুলাল বাওয়ালী, উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, নগই, ফরিদপুর।
মো. জুবায়েরুল ইসলাম, উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, নগই, ফরিদপুর।
এস এম আবু হোরায়রা, মহাপরিচালক, নগই, ফরিদপুর।

 

সম্পৃক্ত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button