
নিজস্ব প্রতিবেদক: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে আগামীকাল (৮ আগস্ট)। এই এক বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন। জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সব দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবমুখী সম্পর্ক স্থাপনই ছিল এই পথচলার মূলমন্ত্র। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই সরকারের কূটনৈতিক দর্শন ও সাফল্য তুলে ধরেছেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ হলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা। তিনি বলেন, “প্রফেসর ইউনূসের সুনাম অনেক সময় এমন দরজা খুলে দেয়, যা সাধারণ কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় অর্জন করা কঠিন হতো।”
এর উদাহরণ হিসেবে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বন্দি বহু বাংলাদেশির সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, “একটি ফোন কলের মাধ্যমে প্রফেসর ইউনূস এই ক্ষমা নিশ্চিত করতে সহায়তা করেন। এটি ইউনূস স্যারের অনুরোধেই সম্ভব হয়েছে। তাঁর এই ‘সফট পাওয়ার’ আমরা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করছি।”
উপদেষ্টা যোগ করেন, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক ব্যবসায় ড. ইউনূসের অবদান বিশ্বজুড়ে তাঁকে যে সম্মান এনে দিয়েছে, তা বাংলাদেশকে এক অনন্য কূটনৈতিক সুবিধা দিচ্ছে, যা সরকার, নাগরিক সমাজ এবং বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্মেও বিস্তৃত।
আগের সরকারের ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার নীতি থেকে সরে এসে বর্তমান সরকার ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও জাতীয় স্বার্থের’ ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী কর্ম-সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে। তৌহিদ হোসেন বলেন, “আমরা এক ধরনের ভারসাম্য তৈরির চেষ্টা করেছি। যদি আমরা ভারতকে কিছু দিই, তাহলে তার বিনিময়ে সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি কিছু পাওয়ার আশা করব। এটি সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।”
সীমান্ত হত্যা ইস্যুতে এই সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “গত এক বছরে আমরা আগের সরকারের তুলনায় অনেক জোরালো ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছি। বিশ্বের আর কোথাও সীমান্তে মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয় না। আমরা ভারতকে জানিয়েছি, এটি গ্রহণযোগ্য নয় এবং দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
একই সঙ্গে সীমান্তে ‘পুশ-ইন’ নিয়েও সরকার কঠোর প্রতিবাদ জানাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
উপদেষ্টা আরও জানান, চিকিৎসা বা কেনাকাটার জন্য ভারতে যাওয়া কমেছে, যা দেশের স্বাস্থ্যখাত ও অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। মানুষ এখন গুরুতর চিকিৎসার জন্য চীন বা থাইল্যান্ডের মতো দেশে যাচ্ছে এবং দেশের বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির মেরুকরণের মধ্যেও বাংলাদেশ একটি ‘বাংলাদেশ-কেন্দ্রিক’ ও জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করছে। উপদেষ্টা কিছু মহলের উদ্বেগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “আমরা চীনের দিকে ঝুঁকছি না; আমরা আমাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করছি।” তিনি উল্লেখ করেন, ১৯৭৫ সাল থেকে সব সরকারের আমলেই চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্থিতিশীল রয়েছে।
একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র চায় আমরা যেন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর না করি, কিন্তু আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক রয়েছে।” এই ভারসাম্যপূর্ণ নীতির ফসল হিসেবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় ১৫ শতাংশ শুল্ক হ্রাসে বাংলাদেশের সাফল্যের কথা তুলে ধরেন।
পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগকে ‘ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির অংশ’ হিসেবে উল্লেখ করে তৌহিদ হোসেন বলেন, “আমরা পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছি না, কেবল একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করছি, যা গত সরকার আমলে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছিল।”
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও কূটনৈতিক মিশন সম্প্রসারণ
উপদেষ্টা স্বীকার করেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ এখনও দীর্ঘ। তবে সম্প্রতি বিমসটেক সম্মেলনে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে কিছু নাগরিককে যাচাই করার স্বীকারোক্তিকে একটি অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন তিনি।
কূটনৈতিক উপস্থিতি বাড়াতে নিউজিল্যান্ডে হাইকমিশন এবং মালয়েশিয়ার জহর বাহরুতে কনস্যুলেট খোলার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া চীনের গুয়াংজু এবং আয়ারল্যান্ডসহ আরও ছয়টি নতুন মিশন খোলার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রবাসী কর্মীদের দুর্ভোগ লাঘবকে অন্যতম অগ্রাধিকার দিয়েছে। পাসপোর্টের জন্য হয়রানি কমাতে ওমানে সরাসরি আবেদনকারীর ঠিকানায় পাসপোর্ট পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। জেদ্দাসহ বিভিন্ন মিশনে প্রবাসীদের জন্য ছায়াযুক্ত অপেক্ষাকক্ষ তৈরি করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সংস্কার প্রসঙ্গে উপদেষ্টা জানান, গত এক বছরে মন্ত্রণালয়ে চুক্তিভিত্তিক কোনো নিয়োগ দেওয়া হয়নি এবং মধ্যপ্রাচ্যের মিশনগুলোতে জনবল সংকট দূর করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
উপসংহারে তৌহিদ হোসেন বলেন, “আমরা সব দেশের সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবসম্মত সম্পর্ক গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে। আমরা কতটা সফল, তার মূল্যায়ন জনগণই করবে।”