জলের গানের রাহুলের বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনার সত্যতা

অনলাইন ডেস্ক: কোটা আন্দোলনকে ঘিরে দেশে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের এক দফা দাবির মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। গত ৫ আগস্ট তার দেশত্যাগের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। ওই সড়কের পাশেই একটি বাড়িতে থাকতেন জলের গানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও লিড ভোকালিস্ট সংগীত শিল্পী রাহুল আনন্দ। সেসময় তার বাড়িতেও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

দুর্বৃত্তদের দেওয়া সেই আগুনে পুড়ে যায় রাহুল আনন্দের নিজের হাতে বানানো তিন শতাধিক বাদ্যযন্ত্র। লুটপাট করা হয় এই সংগীতশিল্পীর বাড়ির মালামালও।

হামলা ও লুটপাটের বিষয়টি নিশ্চিত করে রাহুল আনন্দ বলেন, ‘কিছু লোকজন এসে আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলল, তাদের বললাম, আমি তো তোমাদের জন্যই গান করি। এই আন্দোলনেরও সমর্থক ছিলাম। তবুও আমার বাড়িতে কেন হামলা করছ? তারা বলল, ‘আপনারা বের হয়ে যান, না হলে বিপদ হবে’। পরে আমরা বেরিয়ে চলে আসি।

রাহুল বলেন, এরপরই বাড়িটিতে আগুন দেওয়া হয় এবং ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়। ঘর থেকে লেপ-তোষকও নিয়ে যেতে দেখা যায়। এসিও খুলে নিয়ে যায় লুটপাটকারীরা।

রাহুল আনন্দের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। কারণ ব্যক্তিগতভাবে এই সংগীতশিল্পী কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এমনকি ধর্মের জায়গা থেকেও সবসময় নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছেন।

তবুও জলের গানের অন্যতম এই প্রতিষ্ঠাতার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধর্ম, সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক নানা তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার শুরু হয়।

বিষয়টি নিয়ে আরও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে জলের গান। সেদিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে রাহুলের পরিবারের সঙ্গে কী ঘটেছিল, সেটা তুলে ধরে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন রাহুল আনন্দের পারিবারিক বন্ধু ফারহানা হামিদ।

যেই লেখা নিজেদের ভেরিফায়েড ফেসবুকে পেজে শেয়ার দিয়ে সাম্যের বাংলাদেশ গড়ার আহ্বান জানিয়েছে জলের গান।

ফারহানা হামিদ লিখেছেন, ‘রাহুল আনন্দের বাসা উদ্দেশ্য করে আগুন দেওয়া, লুটপাট বা ভাঙচুর করা হয়নি। আগুন দেওয়া হয়েছে ৩২ এর ‘বর্তমান বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম ও তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ’ সেটুকুতে।

অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি লেখেন, রাহুলদা একটি একতলা বাসায় ভাড়া থাকতেন। একপাশে তাদের সংসার, অন্য পাশে জলের গানের স্টুডিও (অনেকের ভিডিওতে এই বাসা নিয়ে ভুলভাল কথা বলতে দেখেছি আমি)। সেই বাড়িটা ব্যক্তি মালিকানায় ছিল। ৩২ এর সেখানে আরো অনেক এমন বাসা আছে। রাহুলদা ও তার পরিবারের দুর্ভাগ্য এই মায়াময় বাসাটা নতুন মিউজিয়ামের দেয়াল ঘেঁষে এবং সান্তুরের পেছনে ছিল, তাই তার বাসাতেও আগুন দেওয়া হয়।

ফারহানা হামিদ দাবি করেন, রাহুলদাকে উদ্দেশ্য করে আগুন দিলে তারা এই পরিবারকে এভাবে বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ দিতো না। আর সুযোগ না দিলে সেই বাসা থেকে বের হওয়া অসম্ভব।

যারা এই সংগীতশিল্পীর বাড়িতে আগুন দেওয়ার পেছনে ধর্ম, বর্ণ বা সংস্কৃতিকে টেনে আনছেন, তাদের উদ্দেশ্য করে রাহুল আনন্দের বন্ধু আরও লেখেন, রাহুলদার বাসায় আগুনের সাথে ধর্ম, বর্ণ, জাত, সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। তাই এমন গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ করছি। দেশের এই পরিস্থিতিতে যেকোনো গুজব ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। আমরা সচেতন হই।

সবার প্রতি ভালোবাসার বার্তা দিয়ে ফারহানা হামিদ লেখেন, একটা সংসার, একটা দলের বহুদিনের সাধনা, একজন বাচ্চার শৈশবের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আর কারো কোনো কিছু পুড়ে না যাক। ভালোবাসা নেমে আসুক মানুষের মনে, আপনারা তাদের পাশে থাকলে আবার জলের গানের সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইবো- “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।”

এ বিষয়ে এক গণমাধ্যমকে জলের ব্যান্ডের একজন সদস্য ও রাহুল আনন্দের নিকটাত্মীয় ফারহানা হামিদের এই স্ট্যাটাসের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

তাদের ভাষায়, ‘রাহুলদার বাড়িতে অগ্নিসংযোগের পর এখনও পর্যন্ত তিনি মিডিয়াতে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। তবুও রাহুলদা ও জলের গান নিয়ে নানা রকম অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাকে কেন্দ্র করে ধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতি টেনে এনে বিভিন্ন অপপ্রচারও চালানো হচ্ছে। এমন অবস্থায় ফারহানা হামিদ, রাহুলদা ও তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেই এই স্ট্যাটাসটি দিয়েছেন। তারা সবাই চাইছেন, এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো গুজব বা দাঙ্গার সৃষ্টি না হোক।’

রাহুল আনন্দের পরিবারের একজন সদস্য বলেন, ‘এটা সত্যি, রাহুলদার বাড়ি টার্গেট করেই সেখানে আগুন দেওয়া হয়নি। মূলত বাড়িটি বঙ্গবন্ধুর মিউজিয়ামের পাশে থাকায় সেখানে অগ্নিসংযোগ হয়। এছাড়া রাহুলদা কখনো কোনো ধর্ম, বর্ণ ভেদাভেদ মেনে চলেননি। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সম্পৃক্ত থাকেননি। তিনি কেবল গান আঁকড়ে ধরেই বেঁচে ছিলেন। তবুও এই ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেদিনের ঘটনার পরে সামাজিক মাধ্যমে কী চলছে, কেমন গুজব রটেছে, এসব বিষয়েও রাহুলদা অবগত নয়। তবে তিনি বরারবই চেয়েছেন, কোনো ধর্মীয় ট্যাগ দিয়ে জলের গানকে নিয়ে কোনো অপপ্রচার না হোক। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরে আমরা সেই অপপ্রচার ভয়ানকভাবে লক্ষ্য করছি। যে কারণেই ফারহানা আপু রাহুলদা ও তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সবার উদ্দেশ্যে এই স্ট্যাটাসটি দিয়েছেন।’

বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো ইস্যু তৈরি হোক, এমনটা চায় না জলের গান। তাদের কথায়, ‘আমরা সবসময় এই দেশকে ভালোবাসি। সেদিনের ঘটনার জন্য জলের গানের ক্ষতি হয়েছে। তাই বলে আমাদের নিয়ে নতুন কোনো গুজব সৃষ্টি হোক, এমনটা চাই না। আমরা চাই, আমাদের দেশ হোক সাম্যের, সম্প্রীতির। যেখানে সবার একসঙ্গে মিলেমিশে থাকব।’

সেদিন যারা রাহুল আনন্দের বাড়ি থেকে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র লুট করেছে তাদের প্রতি জলের গানের অনুরোধ, আমাদের গানের প্রতিটা বাদ্যযন্ত্র দীর্ঘ সময় নিয়ে হাতে বানানো এবং প্রায় সবার চেনা। কোথাও কেউ কোনো কারণে খুঁজে পেলে তা ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করছি।

সম্পৃক্ত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button