
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এই দেশের মাটিতে ঘাম ঝরিয়ে লাখো কৃষকই আমাদের প্রতিদিনের অন্নের যোগান দিয়ে যাচ্ছেন। দেশের প্রায় ৮০% মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, যারা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, সেই কৃষকরাই আজ সবচেয়ে অবহেলিত ও বঞ্চিত শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। কৃষকের অবস্থা ও দুর্নীতি কৃষকের মাঠে ফসল আছে, অথচ বাজারে দাম নেই। জমিতে শস্য উৎপাদন করতে হলে সার, কীটনাশক ও বীজ প্রয়োজন হয়। সরকারি হিসেবে দেশে যথেষ্ট পরিমাণ সার মজুত থাকলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে—দোকানে দোকানে সারের সংকট। সরকার প্রতি বস্তা ডি,এ,পি সারের দাম নির্ধারণ করেছে ১২৫০–১৩৫০ টাকা, অথচ বাস্তবে বিক্রি হচ্ছে ২৪৫০ টাকা বা তারও বেশি দরে। প্রশ্ন হচ্ছে—যেখানে ভর্তুকির কোটি কোটি টাকা সরকারি খাত থেকে খরচ হচ্ছে, সেখানে কেন সাধারণ কৃষক এই বাড়তি দামের বোঝা বইবে? এ সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে সিন্ডিকেট। যারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত মুনাফা লুটছে, তারা আসলে কৃষকের ঘাম ঝরানো শ্রমকে চুরি করছে। সরিষায় ভুত থাকার মতো, কৃষিখাতেও দুর্নীতির শিকড় গেড়ে বসেছে। খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি একজন কৃষক যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ শস্য উৎপাদন করতে না পারে, তাহলে ২০ কোটিরও বেশি মানুষের খাদ্য সংকট দেখা দেবে। মানুষ না খেয়ে থাকলে সমাজে অশান্তি ছড়িয়ে পড়বে। ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষোভ একসময় আগুন হয়ে উঠবে, তখন সমাজে অরাজকতা সৃষ্টি হবে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে—যেখানে ক্ষুধা, সেখানে শান্তি থাকে না। বাস্তব উদাহরণ 1. চাল, পেঁয়াজ ও তেলের বাজারে অস্থিরতা সম্প্রতি দেখা গেছে পেঁয়াজ ভারত থেকে আমদানি হলেও খুচরা বাজারে দাম কমেনি। সিন্ডিকেট আমদানি করে গুদামজাত করে রেখেছে, ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়েছে। একইভাবে ভোজ্যতেল ও চালের বাজারেও দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম চলছে। 2. মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কৃষক ধান বিক্রি করে ১ কেজিতে ২৫ টাকা পায়, কিন্তু ভোক্তাকে সেই চাল কিনতে হয় ৬০–৭০ টাকায়। প্রশ্ন হচ্ছে—এই পার্থক্যের টাকা যাচ্ছে কার পকেটে? কৃষকের না, ভোক্তারও না—গেল সিন্ডিকেট আর মধ্যস্বত্বভোগীর হাতে। 3. বিদেশি নির্ভরতা দেশীয় উৎপাদনে ঘাটতি তৈরি করে যখন বিদেশ থেকে চাল, ডাল বা তেল আমদানি করতে হয়, তখন বৈদেশিক মুদ্রা ক্ষয় হয়। এভাবে দীর্ঘমেয়াদে দেশ খাদ্য নিরাপত্তা হারিয়ে ফেলে। করণীয় কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা : মাঠ থেকে সরাসরি সরকারের মাধ্যমে কৃষি পণ্য কেনা গেলে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমবে। সার ও বীজের বিতরণে কঠোর নজরদারি : দোকান পর্যায়ে ডিজিটাল মনিটরিং করলে সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে। কৃষি প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ : আধুনিক প্রযুক্তি, জৈব সার এবং উন্নত মানের বীজ সরবরাহ করলে উৎপাদন বাড়বে। সংরক্ষণ ব্যবস্থা : কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেয়ে যেন ফসল নষ্ট না করে, এজন্য গ্রামে গ্রামে গুদাম ও কোল্ডস্টোরেজ গড়ে তুলতে হবে। সচেতন নাগরিক সমাজ : কেবল সরকার নয়, আমাদের প্রত্যেককে কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে—ফসলের ন্যায্য দাম চাইতে হবে, কৃষকের অধিকার রক্ষার দাবি তুলতে হবে। উপসংহার বাংলাদেশের মাটি উর্বর, মানুষ পরিশ্রমী। শুধু দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে পারলেই এই দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে। কৃষকের পাশে দাঁড়ানো মানে শুধু একজন মানুষকে সাহায্য করা নয়—এটি আসলে পুরো জাতিকে রক্ষা করা। “কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, কৃষক মরলে দেশ মরবে।”




