সংগ্রাম দত্ত: বৃহত্তর সিলেট জেলা বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার সুপ্রসিদ্ধ চা নগরী শ্রীমঙ্গল থানা যোগাযোগ পূর্ণ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে শুধু দেশে নয়, বহির্বিশ্বে ও পরিচিত।
সিলেট সদর থেকে ৫০ মাইল ও মৌলভীবাজার সদর থেকে ১৩ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত। বাংলাদেশের পূর্বাংশের পার্বত্য এলাকায় বহু শতাব্দীর প্রাচীন ঐতিহ্য ও গৌরবের স্মৃতি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত উন্নয়নের ক্রমধারা বিকশিত এ শ্রী অঙ্গনে শ্রীমঙ্গল গড়ে উঠেছে। পাহাড়ের পাদদেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অধিকারী চা বাগানের শোভায় শোভায় সুসজ্জিত , বন বিভাগের বৃক্ষরাজির নয়ন মনহরণকারী পর্যটন শিল্প সহ ঝর্ণার দ্বারা নিয়ে বিদ্যমান।
মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের কন্ট্রোল রুম হিসেবে পরিচিত পরিচালনা কেন্দ্রটি সকল অধিকার অতীত সকল অধিকার অর্জনের ঐতিহ্যবাহী এ শ্রীমঙ্গলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন, চা শ্রমিক আন্দোলন, আঠাশ এর কৃষক আন্দোলনে বৃটিশের পুলিশ বাহিনীকে আক্রমণ ও পর্যদস্ত করা, বালিশিরা পাহাড় আন্দোলনে কৃষকের অধিকার সংরক্ষণে দুজনের আত্মদান, চা শ্রমিকের আন্দোলনে বসন্ত, বংশীগঞ্জু সহ জানা-অজানা চা শ্রমিকের রক্তদানের ধারাবাহিকতা রক্ত শপথের তেজস্বী ভূমিকা নিয়ে আজও জাগরুক।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শ্রীমঙ্গল:
—————————————————–
বিংশ শতাব্দীর উষালগ্ন থেকে এক বিংশ শতাব্দীতে পদার্পণে শ্রীমঙ্গলের স্বাধীনচেতা নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ, শিশু, কিশোর অবিস্মরণীয় ভূমিকা নিয়ে ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে ব্রিটিশ বিরোধী জনযুদ্ধে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন উপলক্ষে জাতীয়তাবাদের চেতনায় ও দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত মাতৃভূমির আত্মত্যাগের আদর্শে বলিয়ান ছেলেরা সারা বাংলায় উত্তাল তরঙ্গ তুলে। বিদেশি বস্ত্রসহ পণ্য বর্জন, স্বদেশী দ্রব্যাদী গ্রহণের পক্ষে তীব্র জনজুদ্ধ শুরু করে। মুখর হয়ে ওঠে সারা বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল। শ্রীমঙ্গলের স্বাধীনতাকামী ত্যাগী নেতাকর্মী ও জনতা ব্রিটিশের সুতিবস্ত্র বর্জন করতে দেশি তাঁতের বস্ত্র পরিধান করতে ও খদ্দর পড়তে শুরু করে। তারা বিদেশি পণ্য বর্জন করতে ও বিলেতি ও বিদেশী দ্রব্য বন্ধ করতে জনমত গড়ে তুলে। এ আন্দোলনে স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব দেন ফনি দত্ত পানিনি ( ভোজপুর), গিরীজা চৌধুরী ( ভোজপুর), যতীন্দ্র মোহন দত্ত ( নোয়াগাঁও), সারদা দাস তরফদার (নোয়াগাও), প্রমথ দেব (নোয়াগাঁও), নগেন ঘোষ (সিংবীজ), সুরেশ সোম (উত্তরসুর), যোগেশ চ্যাটার্জী (শ্রীমঙ্গল শহর), জিতেন পাল (রুপশপুর), বড়দা কান্ত সেন (শ্রীমঙ্গল শহর), মহেন্দ্র শর্মা (টিকিরিয়া), সূর্য মনি দেব (রামনগর), বিপিন দাস (উত্তরসূর), যতীন দেব ( শ্রীমঙ্গল শহর), মাস্টার গৌড় গোবিন্দ দেব (ভাড়াউড়া), দ্বিজেন ভট্টাচার্য (শ্রীমঙ্গল শহর), মনমোহন ভট্টাচার্য (বৌলাশী), লাকু দত্ত চৌধুরী (ভুনবীর), লীলা দত্ত চৌধুরী (ভুনবীর), নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী (কালাপুর), হৃদয় দেব (ভাড়াউড়া), অমর দত্ত ( ভৈরব বাজার), যশদা গোবিন্দ গোস্বামী ( কালাপুর), ইন্দ্র হোম চৌধুরী (রুপশপুর), মোহাম্মদ ইউনুস উদ্দিন (পাত্রীকূল), নগেন্দ্র ধর (শ্রীমঙ্গল শহর )প্রমুখ।
১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রচেষ্টা রদ হয়। পরবর্তী কয়েক বছরে আন্দোলন স্থিমিত হয়ে পড়ে। ১৯২০ সালে অসহযোগের রণনিনাদ দুর্বার আন্দোলনের সৃষ্টি করে।
১৯১৯ সালে লাহোর কংগ্রেসে অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে। তখন শ্রীমঙ্গল এলাকার আসাম বিধানসভার সদস্য কলকাতায় অবস্থানরত পরেশ লাল সোম কংগ্রেসের নির্দেশে সদস্য পদত্যাগ করেন। ব্রিটিশ সরকার পুনর্বার নির্বাচন দিলে ঐ সদস্যের ছোট ভাই মৌলভীবাজারে অবস্থানকারী এডভোকেট ইরেশ লাল সোম সদস্য পদ প্রার্থী হলে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা বিক্ষোভ করে। তারা ব্যঙ্গচ্ছলে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজারের চিরতন মুচিকে দাঁড় করিয়ে নির্বাচিত করেন।
১৯২২ সালে সারা ভারত জুড়ে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন এর তীব্রতায় ব্যাপক সভা, সমিতি ,ধরপাকর, জেল-জুলুম শুরু হয়। ভারতের সুনাম ধন্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম কাতারের নেতৃবৃন্দ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের জোয়ারকে বেগবতী করে তুলেন। এ সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শ্রীমতি বাসন্তী দেবী, মৌলানা মোহাম্মদ আলী মৌলভীবাজার খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের জন্য শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছান। শ্রীমঙ্গলে একদল ছাত্র তাদের মাল্য ভূষিত করে সংবর্ধনা জানায়। ওই সম্মেলনটি ১৯২১ সালের ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯২৮ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে লাহোর সেন্ট্রাল জেলে মরণজয়ী যতীন দাস দীর্ঘ ৬৩ দিন অনশন ধর্মঘট করে আত্মাহুতি দেন। শ্রীমঙ্গল ডাকঘর সড়কের মারোয়ারী কালীবাড়ি (বর্তমানে বারোয়ারী কালীবাড়ি) তে এক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। এর আয়োজনে ছিলেন যোগেশ চ্যাটার্জী ও সতীশ সোম ।
১৯২৯ সালে রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হন যুগান্তরপন্থি সূর্যমনি দেব ও জিতেন্দ্র নাথ পাল চৌধুরী।
১৯৩০ সালে শ্রীমঙ্গলে নলিনী গুপ্তকে সভাপতি ও সুরেশ সোম কে সম্পাদক করে কংগ্রেসের শ্রীমঙ্গল থানা কমিটি গঠিত হয়।
১৯৩২ সালে গুপ্ত শাখা অনুশীলন পার্টির শ্রীমঙ্গলের সভাপতি পদে সীতেশ সোম ও সম্পাদক পদে যোগেশ চ্যাটার্জি কে বরণ করা হয়।
লবণ আন্দোলনে সীতেশ সোম অংশ নিলে নোয়াখালীতে পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন। ব্রিটিশের লাল পাগড়ীধারী পুলিশ বাহিনী শ্রীমঙ্গল থানা কংগ্রেসের অফিস ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। তখন তরুণ বিপ্লবী নেতা সূর্য মনি দেব সহ মুকুন্দ চক্রবর্তী ( টিকরিয়া ), মহেন্দ্র শর্মা (টিকরিয়া), মনমোহন ভট্টাচার্য (বৌলাশি) প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা লাকু দত্ত চৌধুরী (ভুনবীর) তদ্বীয় ভগ্নি বিপ্লবী নেত্রী লীলা দত্ত (ভুনবীর), রোহিনী দাস (বৌলাশী), সারদা দে (নিশ্চিন্তপুর), সীতেশ সোম (উত্তরসূর) গ্রেপ্তার হন। জিতেন্দ্র পাল চৌধুরী ও অপর একজন ছাত্রকে ধরে ব্রিটিশ পুলিশ বেদনা প্রহার করে।
১৯৩৮ সালে বিপ্লবী কংগ্রেস নেতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু শ্রীমঙ্গলে এসে নতুন বাজারে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন ও শ্রীমঙ্গল ডাক বাংলোয় তাঁকে জলযোগ করানো হয়। এছাড়া ‘৩৬, ‘৩৮ ,’৪৫ ,’৪৬ সালে পরপর চারবার কংগ্রেস নেতা পন্ডিত জহরলাল নেহেরু বারংবার শ্রীমঙ্গলে এসে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও রেফারেনডাম উপলক্ষে সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন।
১৯৩৯ সালে সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে শ্রীমঙ্গলেও আন্দোলন তুংগে উঠে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। এসময় মোহনলাল করমচাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী) ব্রিটিশ বিরোধী ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের উপর নীতি চালিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চায়। এমতাবস্থায় মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা পরম ধর্ম ‘মারখাও, মেরোনা’ এই নীতিতে আস্থা হারিয়ে বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ কংগ্রেস হতে নানাভাগে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন শুরু করে। এসময় বহু সংখ্যক নেতাকর্মী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়ে যেখানে সাদা চামড়া বা ব্রিটিশের লোক পেত সুবিধা পেলেই তাদের মেরে ফেলত।
কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কংগ্রেস ছেড়ে মুসলিম লীগের যোগ দেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু দীর্ঘদিন স্বগৃহে অন্তরীন থাকার পর হঠাৎ অন্তর্ধ্যান করে জাপানে গিয়ে ভারতবর্ষ মুক্ত করতে সশস্ত্র বাহিনী সংগ্রহ করে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতবর্ষের কয়েকটি স্থানে আজাদ হিন্দ ফৌজ বিশাল আক্রমণ ও বোমাবর্ষণ করে। এ ফৌজ ভারতের মনিপুর রাজ্যের ইম্পল পর্যন্ত অগ্রসর ফলে খাদ্য ও অস্ত্রের অভাবে দিল্লির লালকেল্লা দখল করা সম্ভব হয়নি। জাপানসহ মিত্রশক্তি যুদ্ধে পরাজিত হলে সুভাষ চন্দ্র বসু আত্মগোপন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শ্রীমঙ্গলে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সমর্থক ও আজাদ হিন্দ ফৌজের কিছু সশস্ত্র তরণ এ আন্দোলনে শরিক হন।
১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কর্তৃক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর মুসলিম লীগের রাজনীতির ক্ষেত্র প্রশস্ত হয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় শ্রীমঙ্গলে মোঃ ইসরাইল ও আব্দুস সোবহান চৌধুরী যথাক্রমে সভাপতি ও সম্পাদক পদে নেতৃত্ব দানে মুসলিম লীগ শ্রীমঙ্গল থানা কমিটি গঠিত হয়।
মৌলভীবাজারে রাজনগরের মহিলা বিপ্লবী নেত্রী লীলা নাগের শ্রী সংঘের শাখা ও ত্রিশের দশকে গঠিত হয়। এ সংগঠন বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশ বিরোধী আক্রমণ চালিয়ে শ্রীমঙ্গলে নিরাপদ আশ্রয়ে কর্মীরা চলে আসতো। এ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন মনমোহন ভট্টাচার্য।
১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগ নেতৃত্বের আহবানে আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্যার সৈয়দ মোহাম্মদ সাদ উল্লাহ শ্রীমঙ্গলের মতিগঞ্জ বাজারে মোঃ ইসরাইলের সভাপতিত্বে জনসভায় ভাষণ দেন।
১৯৪৬ সালে নির্বাচনী প্রচার চালাতে হোসেন শহীদ সরোয়ারদী ও নবাব জাদা লিয়াকত আলি খান শ্রীমঙ্গলের হবিগঞ্জ রোডের ঈদগাঁও মাঠে দেওয়ান আব্দুল বাছিতের সভাপতিত্বে বিরাট জনসভায় ভাষণ দেন।
১৯৪৬ সালে নির্বাচনে কংগ্রেস মনোনীত চা শ্রমিক সম্প্রদায়ের জীবন সাঁওতাল এ অঞ্চল থেকে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৪৭ সালে বরিশালের ব্যারিস্টার যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় এসে নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের রেফারেনডম বা গণভোটে পাকিস্তানের পক্ষে ভোটদানের জন্য আহ্বান জানালে অধিকাংশ নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পাকিস্তানের পক্ষে গণভোটে ভোট প্রদান করে।
পাকিস্তানের পক্ষে পড়লো ২ লাখ ৩৯ হাজার ৬১৯ ভোট আর ভারতে যোগদানের পক্ষে পড়লো ১ লাখ ৮৪ হাজার ৪১ ভোট। মুসলীম লীগ ৫৫ হাজার ৫শ ৭৮ ভোট বেশি পাওয়ায় সিলেট ও শ্রীমঙ্গল অঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্রে চলে আসে ।
পাকিস্তান আমলে আন্দোলন সংগ্রামে শ্রীমঙ্গলের রাজনীতির ইতিহাস:
———————————————————————–
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত খন্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়।
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে।
ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল সম্প্রদায়িক। কিন্তু ভারত তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বজায় রাখতে সেকুলার ষ্টেট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যদিও পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান সৃষ্টির পর এক ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন যে, পাকিস্তান শুধু মুসলমানের নয় এখানে হিন্দু ,বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই সমান মর্যাদা বা আইন পাবে। যদিও পাকিস্তানের সংবিধানে তা ছিল না। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিককে পরিণত করা হয়েছিল।
উগ্র সাম্প্রদায়িক জিগিরের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে এমনকি মুসলমানরাও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে ধনিক শ্রেণীর প্রতিভূ পাকসরকার উরতী ধনীক শ্রেণীর মধ্যে বিত্তশালীদের প্রাধান্য সৃষ্টি করে ও শোষণ -নির্যাতন চালায়। সেই শোষক ও শাসক চক্রের অধিকাংশই পাঞ্জাবের ধনীক -বণিক থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী বাঙ্গালীদের প্রতি বৈষম্যমূলক বা বৈমাত্রেয় ভাতৃবৎ আচার আচরণ শুরু থেকেই করতে প্রবৃত্ত হয়। আর এ বৈষম্য ও ভাষা ভিত্তিক শোষণের বিরুদ্ধে তৎকালীন সচেতন বাঙালিরা ক্রমেই প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠতে শুরু করে। তাই পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাংলার রাজনৈতিক সচেতন ও রাজনৈতিকভাবে দুরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিগণ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর এ আন্দোলনে বাংলার হিন্দু,মুসলিম ,খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সবাই ক্রমে এক কন্ঠ, এক সুর হয়ে তীব্র আন্দোলনের প্রক্রিয়া চালাতে থাকেন।
বাংলা ভাষার আন্দোলনের সূত্রপাত অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের বিংশ শতাব্দীর গুড়ার দিকে বহুভাষাভাষী ভারতে প্রশ্ন উঠেছিল যে ভারতের রাষ্ট্রভাষা কি হবে। আর সে সময় উত্তর ভারতের অভিজাত হিন্দু ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ উচ্চ ও সমকণ্ঠে হিন্দির পক্ষে রায় দেন। অপরদিকে তৎকালীন ভারতের অভিজাত মুসলিম ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ উর্দুর স্বপক্ষে সে সময় বক্তব্য রাখেন। এর প্রতিবাদে ১৯২০ সালে ভারতবর্ষের বাংলা ভাষাভাষী বাঙ্গালীদের পক্ষে কলকাতার শান্তিনিকেতনে এক সভায় ডঃ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ এক দীর্ঘ প্রবন্ধ পাঠ করেন। আর সে প্রবন্ধে বলা হয় ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের মুখের ভাষা বা মাতৃভাষা বাংলা। আর সেজন্যে বাংলা ভাষাই ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া উচিত। তাঁর এ দাবী কে সেদিন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ প্রফুল্ল কুমার সরকার সমর্থন করে বক্তব্য রাখেন।
১৯৩৭ সালে আজাদ পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা আকরাম খাঁ তাঁর পত্রিকায় বাংলা ভাষার স্বপক্ষে সম্পাদকীয় ও লিখেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সূত্রপাত হয়।
আবুল মনসুর, কবি ফখরুল আহমেদ, ডঃ শহিদুল্লাহ রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে প্রবন্ধ লিখেন।
অধ্যাপক আবুল কাশেম ১৯৪৭ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের অগ্নিশিখা জ্বালাতে উদ্যোগী হন।
কুমিল্লার প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য হিসেবে
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম সভায় তাঁর সংশোধনী প্রস্তাবটি দাখিল করেন। মূল প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, উর্দুর সাথে ইংরেজিও পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে। একই বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের তাঁর সংশোধনী পস্তাবে ২৯ নং বিধির ১ নং উপ-বিধিতে উর্দু ও ইংরেজির পর ‘বাংলা’ শব্দটি যুক্ত করার দাবি জানান।
তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন, পাকিস্তানের ৫টি প্রদেশের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী। সুতরাং বিষয়টিকে প্রাদেশিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে দেখা উচিত। তাই তিনি গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভূক্তির দাবি করেন। তৎকালীন পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলীম লীগ সদস্যরা বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। ১১ মার্চ পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা উর্দু বিল পাশ হয়ে যায়।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচীর অধিবেশন থেকে ঢাকায় ফিরে এলে, বিমান বন্দরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জানান। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত মূলতঃ সেখান থেকেই।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষী বাঙ্গালীদের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা কড়া নায্য দাবি খর্ব করার প্রয়াস নেন এবং ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকা সফরে এসে জিন্না ও প্রকাশ্য জনসভায় তার সরে ঘোষণা করেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। শ্রুতি মন্ডলী থেকে সাথে সাথে সমধিক দীপ্তকন্ঠে আওয়াজ উঠে ‘নো বাংলা’। পরে ওই প্রতিবাদে পূর্ব বাংলায় ছাত্রসমাজ উদ্দীপ্ত হয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে।
১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক সভায় প্রাদেশিক সরকারের কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তী তিন বছর মার্চ মাসের সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দিবস পালিত হয়। আর এই দিবস পালনের শ্রীমঙ্গল থানার ভিক্টোরিয়া হাই স্কুলের ছাত্ররা শ্রীমঙ্গলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকেরা ও ছাত্রদের রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আয়োজিত মিছিল ও মিটিং এ সাহায্য সহযোগিতা ও উৎসাহ উদ্দীপনা প্রদান করেন। ছাত্রদের মিছিল মিটিং এর নেতৃত্ব দেন রাসেন্দ্র দত্ত, বিরাজ কুসুম চৌধুরী, যোগেন্দ্র দত্ত, শ্যামল সেনগুপ্ত, হিতেন্দ্র গুপ্ত,অচ্যুত কুমার দেব, অখিল চন্দ্র ধর, ডাক্তার ফজলুল হক, মোঃ মোসাদ্দর আলী, সৈয়দ মতিউর রহমান প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ। তাদের সমর্থন জানান মুসলিম লীগের মোঃ ইসরাইল মিয়া, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শ্রী সূর্য মনি দেব, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী অজিত চৌধুরী, ক্ষীরদ বিহারী দেব চৌধুরী, বিমল জ্যোতি দেব চৌধুরী প্রমুখ।
১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বরে জিন্নাহর মৃত্যু হলে ঢাকায় খাজা নাজিম উদ্দিন গভর্নর জেনারেল পদে অভিষিক্ত হলেও বাংলা ভাষাভাষী জনগণের সাথে কোন কাজ করার প্রয়াসী ছিলেন না।
১৯৪৯ এর ২৭ শে নভেম্বর তৎকালীন ডাকসু নেতৃবৃন্দ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শারকলিপি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের নিকট প্রদান করেন। কিন্তু এ দাবি বাস্তবায়িত না হলে বাংলার জনগণ বিশেষত ছাত্রসমাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যা পরবর্তীতে রক্তক্ষয়ী বৈপ্লবিক আকার নিয়ে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত সহ নাম জানা অজানা অনেকেই প্রাণ হারায়। ছাত্র সমাজের রক্তে রাঙ্গা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও রাজপথ। এই ছাত্রদের উপর পাকিস্তানের শাসক চক্রের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে নিহত- আহতদের স্মরণে সারা দেশের ছাত্র সমাজ জীবনপণ মারমুখী সংগ্রামে নেমে পড়েন। এ সংগ্রামে শ্রীমঙ্গলের ছাত্র সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। সারা থানার ছাত্র ছাত্রীদের সমবেত করে বিপ্লবী চেতনায় উদ্দীপিত নেতাকর্মীরা এর প্রতিবাদে সারা শ্রীমঙ্গল শহরে পোস্টারিং করে, মিছিলে মিছিলে শহর মুখরিত হয়ে ওঠে, মিছিলের ভাষা ছিল রফিক, জব্বার, বরকত সালামের রক্ত মুছে ফেলা শক্ত, রক্তের বদলে রক্ত চাই, খুনের বদলে খুন চাই, বাংলার কুসন্তান নুরুল আমিনের ফাঁসি চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি মানতে হবে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নইলে এবার রক্ষা নাই, ছাত্রদের রক্তের রাজপথ রাঙ্গা কেন জুলুমসাহী জবাব চাই ইত্যাদি। মিছিলকে সর্বতোভাবে সমর্থন করে এলাকার হিন্দু, মুসলমান আবাল- বৃদ্ধ -জনতা ঘর থেকে রাস্তায় নেমে পড়ে। শ্রীমঙ্গল পৌরসভা মাঠে হাজার হাজার ছাত্র জনতার উপস্থিতিতে একটি বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র হত্যার বিরুদ্ধে ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সভা অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ মতিউর রহমান। এতে বক্তব্য রাখেন মোঃ শাহজাহান, রাসেন্দ্র দত্ত, অখিল চন্দ্রধর, সাজ্জাদুর রহমান, শ্রী বলাই ভট্টাচার্য প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সভায় বক্তারা নুরুল আমিনের ফাঁসি ও হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের মাতৃভাষা বাংলাকে অবিলম্বে ঘোষণা দেয়ার জোর দাবি জানান।
১৯৫৪ সালে ভাষা সমস্যাকে অন্যতম ইস্যু করে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে এবং ছাত্র হত্যা ও ভাষা আন্দোলনের দাবি রাখার কারণে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে।
এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী কমলগঞ্জ থানার ভানুগাছের কেরামত আলী মুসলিম লীগকে ধরাশায়ী করে বিপুল ভোটাধিক্কে জয়লাভ করেন। এ সময় সংখ্যালঘু সংরক্ষিত আসন থেকে এ অঞ্চল জীবন সাঁওতাল নির্বাচিত হন। উক্ত নির্বাচনে বাংলার জন সাধারনের প্রাণপ্রিয় নেতারা নির্বাচিত হয়ে আসেন শেরেবাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান , অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, নীরদ নাগ, সৈয়দ আশরাফ, মোহাম্মদ তোহা আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, পীর হাবিবুর রহমান, প্রসূন কান্তি রায় বরুণ, রণেশ মৈত্র প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। পরবর্তীতে পূর্ব বাংলার জনগণের আন্দোলনের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে বাংলা ও উদ্যোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দান করে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম ও ১৯৬৩ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি শ্রীমঙ্গলের বালিশিরা কৃষক আন্দোলনের পুলিশের গুলিতে নিহত গনু মিয়া ও ছালিকের স্মৃতিকে স্মরণীয় -বরণীয় করে তুলে তুলতে ১৯৬৯ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির কদিন পূর্বে শহীদ ছালিকের ফুফাতো ভাই ন্যাপনেতা মোঃ শাহজাহান মিয়া, সাইয়িদ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ মুয়ীজুর রহমান, ছাত্র ইউনিয়নের এককালীন ফাউন্ডার জিএস পরে আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ ইলিয়াস, মোহাম্মদ আলতাফুর রহমান চৌধুরী, ছাত্রলীগ নেতা এম এ রহিম, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, বিশিষ্ট প্লান্টার মুখলেসুর রহমানের প্রচেষ্টায় শ্রীমঙ্গল পৌর টাউন কমিটির মাঠে মুসলিম লীগের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও শ্রীমঙ্গলে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপিত হয়। এই শহীদ মিনারই শ্রীমঙ্গলের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসেবে পরিচিত এবং প্রতি বছরই ১৯শে ফেব্রুয়ারি ২১ শে ফেব্রুয়ারি ২৬ শে মার্চ জাতীয় দিবস, বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি দিবস উপলক্ষে সমস্ত শ্রীমঙ্গল থানার সব কটি সংগঠন এখানে শহীদ আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে পুষ্পস্তবকে – স্তবকে সাজিয়ে রাখে সারা শহীদ বেদীটি।
১৯৫৭ সালে মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠিত হলে মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া, রাসেন্দ্র দত্ত, সৈয়দ মতিউর রহমান সহ অসংখ্য তরুণ ন্যাপ এ যোগ দেন এবং তাদের নেতৃত্বে শ্রীমঙ্গলে ন্যাপ সুসংগঠিত কমিটি গঠিত হয়। মুসলিম লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে ন্যাপ একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলে রূপ নেয় ।
১৯৬৩ সালে শ্রীমঙ্গলে বালিশিরার কৃষকের অধিকার সংরক্ষণের আন্দোলনে পাক বাহিনীর পুলিশের হাত থেকে জঙ্গি কৃষক আন্দোলনে নেতৃবৃন্দ ছয়টি রাইফেল কেড়ে নেয়। পুলিশের গুলিতে ছালিক (১৯) ও গণু (৮০) নামের দুজন লোক মারা যায়। শেষ পর্যন্ত পাক সরকার নতিস স্বীকার করতে বাধ্য হয় কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বের কাছে। এসবের নেতৃত্ব দেন ন্যাপ নেতা রাসেন্দ্র দত্ত, মোঃ শাহজাহান মিয়া, টিকরিয়ার মেম্বার মোঃ আব্দুর রহিম, আব্দুল খালিক, আব্দুল হক, চাঁন মিয়া মহালদার সহ অনেকে। এছাড়া পুলিশে নির্যাতনের বিরুদ্ধে শ্রীমঙ্গলের তীব্র আন্দোলনে মিছিল মিটিং অনুষ্ঠিত হয়।
শ্রীমঙ্গল শহরের নতুন বাজারে সিলেট জেলা ন্যাপ সভাপতি নবাব আলি ছবদর খান রাজা সাহেব এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন আফ্রিকা, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকার ৩৮৮ কোটি নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর বলে পরিচিত ন্যাপের মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। এ সময় নবাব আলী ছবদর খান রাজা সাহেবের নেতৃত্বে শ্রীমঙ্গলের সিন্দুরখান থেকে ২২ মাইল পায়ে হেঁটে ২৫ হাজার মানুষ মৌলভীবাজার গিয়ে এসডিওর কার্যালয় ঘেরাও করে বালিশিড়া পাহাড়কে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করার আওয়াজ তুলে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের দাবি জানায়। এযাবৎ এতো বড় মিছিল বৃহত্তর সিলেটের কোথাও অনুষ্ঠিত হয়নি।
১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহ র সম্মিলিত বিরোধীদলের পক্ষে যে নির্বাচনী কমিটি হয়। তার সম্পাদক পদে ডাক্তার মোঃ আব্দুল আলী, যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে ন্যাপনেতা রাসেন্দ্র দত্তকে করা হয়। উক্ত নির্বাচনী কমিটিতে ছিলেন মোঃ আলতাফুর রহমান, হাসমত আলী, হাজী আসদ্দর আলী, সৈয়দ মতিউর রহমান প্রমুখ। এ সময়ে ফাতেমার নির্বাচনে গিয়ে আক্রান্ত হন ন্যাপের রাসেন্দ্র দত্ত, মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন শুরু হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বারবার গ্রেফতার ও পরে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে রাষ্ট্রদুইতার অপরাধে কারারুদ্ধ হন। এ সময় ছয় দফাকে সমর্থনের প্রশ্নে ভাসানীর নেতৃত্বে বিরোধী রিকোজিশন কাউন্সিল অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ প্রথম রাজনৈতিক দল হিসেবে ৬ দফা কে সমর্থন দেন।
শ্রীমঙ্গলে ন্যাপের নেতৃবৃন্দ ও ডাকের ১১ দফা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ৬ দফাকে সমর্থন দিয়ে ১১ দফা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
১৯৬৮ সালে একদল ছাত্র এম এ রহিমের নেতৃত্বে শ্রীমঙ্গল থানা ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
১৯৬৮ সালে ১৩ ডিসেম্বর ইত্তেফাক পুনঃপ্রকাশের দাবিতে শ্রীমঙ্গল নতুন বাজারে নিউনেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরন অবমুক্ত করার প্রস্তাব নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও ন্যাপ এর উদ্যোগে এক যৌথ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এতে ছিলেন এম এ রহিম, কনক লালদেব চৌধুরী, দীপক সেন, বিরাজ সেন তরুণ, বিজয় ভূষণ চৌধুরী, খলিলুর রহমান, আব্দুল মতলিব, একরাম হোসেন চৌধুরী, মাহবুব এলাহী প্রমুখ। এবছরই গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ বা ডাক গঠিত হয়। এতে আব্দুর রউফ তরফদার, মোঃ শাহজাহান মিয়া, রাসেন্দ্র দত্ত, আলতাফুর রহমান চৌধুরী, ডাক্তার মোঃ আব্দুল আলী, সৈয়দ মূয়ীজুর রহমান প্রমুখ। কিন্তু ন্যাপ ও ছাত্রলীগ নিজ নিজ শক্তিতে কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করে।
১৯৬৯ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাবার পর বছরের মাঝামাঝি সময়ে শ্রীমঙ্গলে এসে ডাক্তার মোঃ আব্দুল আলীর রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাসভবনে আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। তাতে সংবর্ধনা পরিষদের সভাপতি করা হয় ট্রেড ইউনিয়নিস্ট ও চা বাগান কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মোঃ ইলিয়াসকে। এর কিছুদিন পরই মোঃ ইলিয়াস ও আলতাফুর রহমান চৌধুরী এন ডি এফ ছেড়ে আওয়ামী লীগের যোগ দেন। উপরোক্ত তিনজনের নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী লীগের শ্রীমঙ্গল থানা কমিটি।
১৯৭০ সালের ৬ এপ্রিল পাক সরকার জয় বাংলা মামলা তথা পাকিস্তান ভাঙ্গার অভিযোগে সামরিক আইনের স্কিষ্টটি এমন এল আর ক্লোজ এইট এর অধীনে ন্যাপ নেতা রাসেন্দ্র দত্ত, মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া, ছাত্রলীগ নেতা এম এ রহিম ও এস এ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে মৌলভীবাজার জেলহাজতে প্রেরণ করে। পরদিন শ্রীমঙ্গল পৌরসভা মাঠে ন্যাপের পূর্বনির্ধারিত জনসভা থাকায় এতে যুগের অগ্নিকন্যা বলে খ্যাত তৎকালীন ন্যাপনেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ও সাবেক ডাকসুর ভিপি ও ন্যাপের সহ-সভাপতি আহমেদুল কবির ওই জনসভায় তাদের মুক্তির দাবিতে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের হাজারো নেতাকর্মী অসাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার তাদেরে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে নৌকা নিয়ে দাঁড়িয়ে ৭ ডিসেম্বর জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদে মোহাম্মদ ইলিয়াস ও মোহাম্মদ আলতাফুর রহমান চৌধুরী জয়ী হন।
নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়া খান নানা অজুহাত তুলে বিলোম্বিত করেন। বঙ্গবন্ধু ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার দাবি উত্থাপন করেন। সারা বাংলার মানুষ তাতে অখুণ্ঠ সমর্থন দেয়। বাংলার মানুষ তীব্র প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। ধনী উঠে “সংসদে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। রূপ নেয় মহান মুক্তিযুদ্ধের।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ:
—————————————-
১৯৭১ সালের ১ মার্চ দুপুর একটায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়া আইয়া খানের ভাষণ রেডিওতে প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে শ্রীমঙ্গল পৌরসভা কার্যালয় থেকে ন্যাপ নেতা রাসেন্দ্র দত্ত চৌধুরী, মোঃ শাহজাহান মিয়া ও সৈয়দ মূয়ীজুর রহমান স্লোগান দিয়ে মিছিল শুরু করলে মুহূর্তেই শ্রীমঙ্গল শহরের চারদিক থেকে ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলনে উদ্বৃত্ত আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের নেতৃত্বে সারা শ্রীমঙ্গল মুখরিত হয়ে ওঠে। এই মিছিলে নেতৃত্ব দেন উপরোক্ত তিনজনসহ ন্যাপ নেতা ক্ষীরদ দেব চৌধুরী, রাজেন্দ্র দাস, গোপাল সেন, ধীরেন্দ্র দত্ত পানু, সুভাষ দত্ত, ডাক্তার ফজলুল হক, মোঃ আব্দুর রহিম, সাইয়িদ মুজিবুর রহমান, দিলীপ কুমার রায়, মোঃ আব্দুল লতিফ, মোঃ আব্দুল হক, হীরালাল হাজরা, মোহাম্মদ ফতে আলী, মোহিত ভট্টাচার্য, রাধাকান্ত তাঁতি, বীরেশ দেব, বাবলা দেব চৌধুরী, আব্দুল কাইয়ুম তরফদার, সত্য ভৌমিক, মামুন চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা মোঃ ইলিয়াস, মোহাম্মদ আলতাফুর রহমান চৌধুরী, ডাক্তার মোঃ আব্দুল আলী, ডাক্তার রমা রঞ্জন দেব, মোহাম্মদ আরজু মিয়া, মনির মিয়া, আতাউর রহমান, এম এ রহিম, এসে এ মুজিব, মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন, মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানসহ হাজার হাজার ছাত্র জনতার বিরাট মিছিল বের হয়। মিছিলে স্লোগান ছিল “জয় বাংলা -জয় সমাজতন্ত্র, বিশ্বে একটা নতুন দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা- মেঘনা -যমুনা, সামরিক জান্তা নিপাত যাক, ৬ দফা ও ১১ দফা জিন্দাবাদ, বাঁশের লাঠি তৈরি করো বাংলাদেশ স্বাধীন কর।” মিছিল শেষে পৌরসভার মাঠে হাজার হাজার জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। তখন হতেই প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে লাঠিসুটাসহ জঙ্গি মিছিল চলতে থাকে। বিভিন্ন হাটবাজারে, বাগানে বাগানে, গ্রামে-গঞ্জে ছাত্র-জনতার বিক্ষুব্ধ মিছিল অগ্নিরূপ ধারণ করে।
৩রা মার্চ সিলেটে পাক বাহিনীর গুলিবর্ষণে একজন মারা গেলে মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতার ঢল সর্বত্র বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।
সেই মুহূর্তে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকন্ঠের গগন বিদারী আবেগময় ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের সৃষ্টি হয় ও তীব্ররূপ পরিগ্রহ করে।
২৩ মার্চ শ্রীমঙ্গলের ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার রক্তরাঙা সূর্যস্নাত পতাকা উত্তোলিত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন এম এ রহিম, একরাম হোসেন চৌধুরী, বিরাজ সেন তরুণ, মঈন উদ্দিন, সৈয়দ মূয়ীজুর রহমান প্রমুখ।
২৪ মার্চ মৌলভীবাজারের তৎকালীন পাঞ্জাবি এসডিপিও শ্রীমঙ্গলে এসে পুনরায় পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করেন।
২৫ মার্চ সংগ্রামে লিপ্ত বিদ্রোহী জনতা থানা ঘেরাও করে রেখে থানার ভিতরে ন্যাপ নেতা রাসেন্দ্র দত্ত, সৈয়দ মূয়ীজুর রহমান, ছাত্রলীগ নেতা একরাম হোসেন চৌধুরী থানা কর্তৃপক্ষের সামনে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা পুনঃ উত্তোলন করেন । এসময় থানায় উপস্থিত জনতার রুদ্ররোষের মুখে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য অবলোকন করে।
২৭ মাঠ রাতে শ্রীমঙ্গল থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম থানার জমাপড়া বন্দুকগুলো প্রতিরোধ সৈনিকদের হাতে তুলে দেন। প্রকাশ্য দিবালোকে স্বতঃস্ফূর্ত জনতা মহাসড়কে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকে। পাকবাহিনী যাতে শ্রীমঙ্গলে না আসতে পারে সেজন্য রাস্তায় রাস্তায় গাছ ফেলা হয়। সাইয়িদ মুজিবুর রহমান, রাসেন্দ্র দত্ত, মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ সুসংগঠিত শ্রমিক কৃষকের সম্মিলিত শক্তিতে বলিয়ান হয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করেন। এদিকে গণপরিষদ সদস্য মোহাম্মদ ইলিয়াস ও আলতাফুর রহমান চৌধুরী বালিশিরা ভেলী বাগান এলাকায় আত্মগোপন করে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে গোপন সভায় মিলিত হন। স্থানীয় কৃষক শ্রমিক, ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের এক পর্যায়ে রাস্তার দু’ধারে বাড়িঘর, দোকানপাট ও সম্ভবস্হলে ইট -পাথর ভাঙ্গা কাঁচ খন্ড ইত্যাদি জড়ো হতে থাকে। শত্রুর সেনাদের অতর্কিত আক্রমণকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে রাত ১০টার দিকে শ্রীমঙ্গল থানার ওসি সংবাদ দেন যে, কিছু বাঙালি সৈনিক শমশেরনগর হতে তাদের প্রিয়জনদের উদ্ধার করার মানসে কুমিল্লা সেনানিবাসে যাবার জন্য রাস্তা করে দিতে ছাত্র-জনতা ও তরুণদের সাহায্য সহযোগিতা চান। সেজন্য তাদের সহযোগিতায় সোনালী ব্যাংক ম্যানেজার বাদশা মিয়া, শহিদুল আলম, সৈয়দ মূয়ীজুর রহমান, মরহুম রিস্কা চালক আনিস ও প্রাক্তন সৈনিক মুকিত লস্কর এগিয়ে আসেন। তাদের আহবানে সাতগাঁয়ের চা শ্রমিকরা ও সহযোগিতা করেন ও রাস্তার উপর রাখা বড় বড় গাছগুলো কিছুক্ষণের জন্য অপসারিত হয়। সৈনিকরা কুমিল্লার পথে প্রিয়জনদের সাথে মিলিত হতে সংগ্রামী চেতনা নিয়ে এগিয়ে যান। তাদের কজন গিয়ে তখন প্রিয়জনদের সাথে মিলিত হতে পেরেছিলেন তা জানা নেই।
২৮ মার্চ বিকেলে সংগ্রাম পরিচালনা জন্য ফরিদ আহমদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ও সদস্যপদে ডাক্তার আব্দুল আলী, মুহিবুর রহমান, কমলেশ ভট্টাচার্য, সাইয়িদ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।
আনসার বাহিনীর ক্যাপ্টেন এমএ মুসাব্বির, ক্যাপ্টেন মতলব, এম এ রহিম, শহিদুল আলম, মোঃ শাহজাহান মিয়া, রাসেন্দ্র দত্ত, আব্দুর রহিম, দীপক সেন, সৈয়দ মূয়ীজুর রহমান গ্রামে গঞ্জে ঘুরে আনসার, মুজাহিদ, প্রাক্তন সৈনিক জোগাড় করে গ্রামগঞ্জ ও চা বাগানের ম্যানেজারদের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সংগ্রাম কমিটির হাতে অর্পণ করেন ও কমিটির উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধা স্কোয়াড গঠন করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেওয়া হয়।
২৯ মার্চ আন্দোলনী জনতার মিছিলের উপর ভৈরব বাজার নামক স্থানে পাক সেনারা আত্মগোপন করে সহসা গুলি ছুঁড়ে। এতে হরমুজ মিয়া নামক এক ব্যক্তি নিহত হয়।
৩০ মার্চ মৌলভীবাজারে অবস্থানরত পাক সেনারা শ্রীমঙ্গলে আগুন লেগেছে এই অজুহাতে ফায়ার ব্রিগেডের দুটি গাড়ি প্রেরণ করে। শ্রীমঙ্গলের সংগ্রামী দামাল ছেলেরা দমকলবাহিনীর গাড়িতে এসে সেনাবাহিনীর লোক আছে সন্দেহে গাড়িটি আটক করে একটি গাড়ির ফায়ারম্যানদের তুমুল জেরা শুরু করেন।
এক পর্যায়ে পিছনে আসা গাড়িটি সুযোগ বুঝে কুড়িয়ে দ্রুত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ওই রাতে পাক সেনারা মৌলভীবাজার ছেড়ে যাবার পথে মৌলভীবাজারের তৎকালীন এসডিও অবাঙালি নাসিম ওয়ার্কারকে তাদের সাথে সিলেটের পথে নিয়ে যায়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে শ্রীমঙ্গলের ছাত্র ও তরুণকর্মীরা শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া হাইস্কুল মাঠে কুচকাওয়াজ ও প্যারেডে মিলিত হয়। এ সময়ে পাক সেনাদের মনে শ্রীমঙ্গলে হাজার হাজার ভারতীয় সেনার উপস্থিতি কল্পিত ভীতির সঞ্চার হয়।
৩১ মার্চ গণপরিষদ সদস্য মানিক চৌধুরী শ্রীমঙ্গলে এসে স্বাধীন বাংলা সরকারের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে নির্দেশ জারি করেন। এসময় কর্নেল (অব:) আব্দুর রব, ডাক্তার আব্দুল আলী, মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন ইপিআর জওয়ানদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সমবেত করেন।
স্বাধীন বাংলা বেতারসহ বিশ্বের বিভিন্ন বেতার কেন্দ্র থেকে পাক সেনাদের নির্বিচারে অত্যাচার চালিয়ে যাওয়া, গণহত্যা ও বাঙ্গালীদের সশস্ত্র প্রতিরোধের সংবাদ বেতারে প্রতিনিয়ত ভেসে আসতে থাকে। এ
সময় আনসার বাহিনী কমান্ডার মানিক চৌধুরী ও মুকিত লস্কর শ্রীমঙ্গল ভিক্টোরিয়া হাই স্কুল মাঠে উৎসাহিত তরুণদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন।
১ এপ্রিল কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী ও মেজর সি আর দত্ত যৌথভাবে হবিগঞ্জ থেকে শ্রীমঙ্গল এসে বিরাট প্রতিরোধ বাহিনী নিয়ে পাকসেনাদের মোকাবেলা করার জন্য মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হন।
মেজর সি আর দত্ত, মুজাহিদ ক্যাপ্টেন এমএ মুসাব্বির কে নিয়ে তা নিয়েও মুজাহিদদের সংগ্রহ করেন। এদের মধ্যে শ্রীমঙ্গলের মুকিত লস্কর, রিক্সা চালক মোঃ আনিস সিলেটের রণাঙ্গনে পাকসেনাদের হাতে মারা যান।
২ এপ্রিল এ বাহিনী মৌলভীবাজার পর্যটন গেস্ট হাউসে অবস্থান নেয়।
উল্লেখ্য, ২৭ মার্চ থেকে শ্রীমঙ্গল পৌরসভা কার্যালয়কে কন্ট্রোল রুম করে বৃহত্তর সিলেটে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বীর বিক্রমের দুর্জয় আক্রমণের প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা শ্রীমঙ্গলের স্বাধীন বাংলার পতাকা সমুন্নত রেখেছিল। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী, ব্রিগেডিয়ার পান্ডে দু’বার শ্রীমঙ্গলে আসেন।
৬ এপ্রিল পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। সিলেট বিমানবন্দরে পাকবাহিনী শক্তি বৃদ্ধি করে ও এর পূর্ণাঙ্গ কন্ট্রোল যুদ্ধবস্থার পর্যায় বহন করে। মুক্তাঞ্চলের তেলিয়াপাড়া ও শ্রীমঙ্গল কন্ট্রোল রুম থেকে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ব্যাচের পর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র সংগ্রামে পাঠাতে শুরু করেন। এ সময়ে দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাপ্টেন আজিজ সিলেটের রশিদপুরের রণাঙ্গনে মারাত্মকভাবে আহত হন। ওই সময় বেশ কিছু মুক্তিসেনা শহীদ হন। পাকসেনারা স্থল ও আকাশপথে অবস্থান নিয়ে গোটা সিলেটকে নিয়মিত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে। এ সময় শালুটিকরের যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ মিয়া পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ভীষণভাবে প্রহৃত হন। তখন উপস্থিত বুদ্ধির ফলে মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় মৃতবৎ পরে থেকে পাক সেনারা চলে গেলে তিনি বহু কষ্টে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন।
এক পর্যায়ে পাক সেনারা যাতে খাদ্য ও জ্বালানি পেতে না পেরে সেজন্য শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন পাম্পের সমুদয় পেট্রোল তৎকালীন বর্মাছড়া ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। খাদ্য গুদামের তালা ভেঙ্গে চাল ও গম মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে নেওয়া হয়। মৌলভীবাজারের ন্যাশনাল ব্যাংকের ডিনামাইট ফাটিয়ে লকার ব্যাংকে গাড়ি যুগের সমুদয় টাকা মুক্তিবাহিনীর সমর্থিত নেতারা নিয়ে যায়। শ্রীমঙ্গলের এলএসডি গুদামের দুয়ার খুলে জনসাধারণকে খাদ্য সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া হয়।
২৮ এপ্রিল সকাল দশটায় মেজর কাজী নুরুজ্জামান শ্রীমঙ্গলে আসেন। তখন যুদ্ধাবস্থা খারাপের দিকে। পরিবেশ থমথমে। হাজারে হাজারে আবাল বৃদ্ধ বণিতা সীমান্ত অতিক্রম করে প্রাণ নিয়ে ভারতে পালাতে শুরু করে। অন্যদিকে শুরু হয় একশ্রেণীর স্বাধীনতা বিরোধী চক্র সুযোগ বুঝে লুণ্ঠন নিপীড়ন চালিয়ে যায়। এমতাবস্থায় পাক বাহিনীর দুটি মানব বিমান এসে দীর্ঘ অর্ধঘন্টা যাবত বোমাবর্ষণ করতে থাকে। মাজদিহি চা বাগানের ফ্যাক্টরি ও শ্রীমঙ্গলে মুদাব্বির হোসেনের রেশন দোকানসহ বসতবাড়িটি বোমার আঘাতে ভস্মীভূত হয়। জীবন্ত দগ্ধ হন একজন মহিলা ও আহত হন মুদাব্বির হোসেনসহ একজন কাঠমিস্ত্রি। বোমার আগাতে গৌরাঙ্গ মল্লিক ও একজন রিকশাচালক নিহত হয়।
৩০ এপ্রিল পাকবাহিনী প্রথমবারের মতো শ্রীমঙ্গলে প্রবেশ করে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালাতে শুরু করে। মির্জাপুর চা বাগানের প্রধান সহকারী অঘোর ভট্টাচার্যকে খবর দিয়ে এনে পাকসেনারা নির্যাতন করে ঢাকা -সিলেট মহাসড়কের ভূনবীর ইউনিয়নের রাস্তার পাশে হত্যা করে।
নারায়ণছড়া চা বাগানের কর্মচারীর মোস্তফা আলম ও তাঁর মেয়ের জামাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
রাজঘাটের চা শ্রমিক নেতা পবন তাঁতি ও ফুসকরী চা বাগানের চা শ্রমিক সম্ভু সিংহকে হত্যা করা হয়।
ভাড়াউড়া চা বাগানের ৪৫ জন চা শ্রমিককে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ সংলগ্ন ভাড়াউড়া গ্রামে ব্রিজের ডান পাশে দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। এরা হচ্ছেন হোছনী হাজরা, চিনি লাল হাজরা, গুঁড়া হাজরা, টিমা হাজরা, শনি চারা হাজরা, হুলা গোয়ালা, হিংরাজ হাজরা, কৃষ্ণ চরণ হাজরা, মহারাজ হাজরা, নুনু লাল হাজরা, মংগুরা হাজরা, ডুমার চান তুরিয়া, সম মাঝি, নকুলা হাজরা, কালাচাঁদ ঘাটুয়ার, সুকনন্দন বিকিয়াচরন, ইন্দ্র ভূঁইয়া, ফাগু হাজরা, রামলাল হাজরা, জগ্গু হাজরা, বিশ্বম্ভর হাজরা, হিরুয়া হাজরা, শিবমুড়া চৈইত ভূঁইয়া, আগুন ভূঁইয়া, বুকই বেলি রাজকুমার মাল, রামলাল মাল, যোরুয়া গৌড়, রামকৃষ্ণ গৌড়, রাম চরণ গৌড়, গবিনা গৌর, ভজুয়া হাজরা, গঙ্গা বারই, ডিগলাল এর ছেলে জগতদেও কাহার, গঙ্গা কুর্মী, চুনি হাজরা, অমৃতা হাজরা, ক্ষুদিরাম হাজরা, বীরবলি হাজরা, ব্রিজ নারায়ন গোয়ালা, রামদেও হাজরা, মংরা তুরিয়া, হরকু হাজরা, রামছরুক হাজরা।
মে মাস হতে পাকবাহিনী সারা শ্রীমঙ্গলে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও নির্যাতন চালাতে শুরু করে।
শ্রীমঙ্গল শহরের স্টেশন রোড, মৌলভীবাজার রোড, কলেজ রোডকে আগুন লাগিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। বিবিসির সাংবাদিক মার্ক টালি যা’ স্বচক্ষে দেখে গিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছেন।
শ্রীমঙ্গলে যুদ্ধকালীন সময়ে পাক বাহিনীর ক্যাপ্টেন তারেক সিড ও ক্যাপ্টেন সেলিম ( ডাক বাংলোয়), মেজর এরশাদ (ওয়াপদা রেস্ট হাউস), লেফট এন্ড কর্নেল ইয়ামিন বাট সিন্দুরখান ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থান করে চা বাগান ও গ্রামাঞ্চলে নারকীয়
তান্ডব লীলা চালায়।
ন্যাপনেতা রাসেন্দ্র দত্তের নোয়াগাঁও গ্রামের বাড়ি হতে ইদ্রিস মিয়া সহ কিছু সংখ্যক দালাল এমবিবিএস ডাক্তারের যন্ত্র পাতিসহ লাখ লাখ টাকার মালামাল লুট করে গড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এভাবে শ্রীমঙ্গলের ধনাঢ্য হিন্দু পরিবার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের বাড়িঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
কিছু সংখ্যক পাকবাহিনীর সহযোগী দালাল ও স্বাধীনতা বিরোধী লোকজন স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকজনের বড় বড় বাড়ি ও সম্পত্তি দখল করে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়।
পাকবাহিনীর সহযোগিতা গল্পে স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা শ্রীমঙ্গল পৌরসভার চেয়ারম্যান দেওয়ান আব্দুর রশিদের নেতৃত্বে সারা থানায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। যারা ওই সময় মুক্তিবাহিনীকে ধরিয়েছে বা ধর্ষণ , নিপীড়ন, নির্যাতনে লিপ্ত ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন মুসলিম বাংলার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও পরবর্তীকালে ‘৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার হত্যার পরে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে তারা ও তাদের সন্তান-সন্ততিরা বড় বড় ধনাঢ্য রাজনৈতিক দলে সামনে পুনঃ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে বিধায় তাদের নাম নিরাপত্তার প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় উল্লেখ করা যাচ্ছে না। কিন্তু তাদের ওই সময়ের মধ্যযুগীয় বর্বরোচিত কার্যক্রমের স্মৃতি স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত প্রত্যক্ষদর্শী এবং জ্ঞাত লোকজনদের কাছে এখনো ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত কিছু দুঃসাহসী ও বিপ্লবীর মনে পাল্টা নেবার প্রবৃতি জাগরূক হয়ে ওঠে।
শহরের পূর্বাশা আবাসিক এলাকার খালে ৮জন যুবককে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। এরা হচ্ছেন ছয়বল রিকিয়াসন, পটুয়া রিকিয়াসন, দরবারিয়া রিকিয়াসন, রঘুনন্দন রুহিদাস, ছিকনন্দন রুহিদাস, মরুলিয়া বারই, কানাইয়া ভার ও মহাবীর রিকিয়াসন।
সিশেলবাড়ী চা বাগানে টিলা বাবু এম এ হান্নান পাকবাহিনীকে দিয়ে ধরিয়ে পূর্ব আক্রোশের গিয়ার হিসেবে কুশো ও নিমাই নামক দুই চা শ্রমিককে হত্যা করে। এভাবে তার সাথে সুসম্পর্ক না থাকার কারণে টিলা বাবু আফতাব উদ্দিন ও অপর একজন গুদাম বাবুকে হত্যা করা হয়।
মুক্তিসেনাদের খাদ্য সরবরাহকালে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে প্রাণ হারান শংকর দেবনাথ।
অক্টোবর মাসে এক দল মুক্তিযোদ্ধা ভূনবীরের গঙ্গেশ রঞ্জন দেবরায়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তারা বিলাসের পুলে অপারেশন চালাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সেখানে যাবার পূর্বে পথিমধ্যে পাক সেনাদের সাথে যুদ্ধে ধরা পড়েন মুক্তিযুদ্ধা সমীর সোম। তাঁকে পড়ে শ্রীমঙ্গল শহরস্হ সাধুবাবা গাছের নিচে হত্যা করে ছড়ায় ফেলে দেওয়া হয়। এভাবে রানু ও মুকিত নামের দুই ব্যক্তিকেও হত্যা করা হয়।
সমীর সোমের সহকর্মী মুক্তিযোদ্ধা সেদিন পালিয়ে গিয়ে জীবন বাজি রেখে শ্রীমঙ্গল শহরে পাক বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করতে এসে মুক্তিযোদ্ধা মইনুদ্দিন, সম্ভু নায়েক ও অর্জন পোদ্দার ধরা পড়ে পাক বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান।
পাক বাহিনীর ইনফরমার কুটি সেন ও হাবিব লস্কর ভারতীয় মেজর বলে ন্যাপনেতা ধীরেন্দ্র দত্ত পানুকে পাক সিকিউরিটি দ্বারা ধরিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে লোহার রোডে ঝুলিয়ে ইলেকট্রিক শর্ট ও মারধর করে পড়ে ছেড়ে দেয়। এভাবে কুটেশন দেবের বাড়ির এক যুবককে তাদের দা দিয়ে ধরিয়ে নির্যাতন করিয়েছেন। আর সেই ইনফর্মার কুটি সেনসহ ওপর দুই ব্যক্তিকে পাকসৈন্যরা ঘরের ভিতর খুটির সাথে বেঁধে ঘরে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে নারকীয়ভাবে হত্যা করে।
পাক বাহিনীর শ্রীমঙ্গল ওয়াবদা গেস্টহাউজ কে সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করে। সেখানে একটি বিনোদন কেন্দ্র ও গড়ে তুলে। বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের দালাল ও সহযোগীদের রিপোর্ট অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক কর্মীদের ধরে এনে নির্যাতন করে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হতো। শেষে তাদের ভূরভুরিয়া ছড়ার পাড়ের বধ্যভূমিতে হত্যা করা হতো। বিনোদন কেন্দ্রীয় সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে শারীরিক নির্যাতন ও পালাক্রমের ধর্ষণ করে হত্যা করা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। এছাড়া ভানুগাছ রোডে লেবার ওয়েলফেয়ারের ডিডিএল এর কার্যালয় ও কোয়ার্টারগুলোকে সন্দেহভাজন লোকদের ধরে এনে জড়ো করে নানা পদ্ধতিতে নির্যাতন চালিয়ে আটক করা হতো। যাদের হত্যার নির্দেশ দেওয়া হতো তাদের বিডিআর ক্যাম্প সংলগ্ন সাধু বাবার গাছ তলার বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো।
শ্রীমঙ্গলের ভূরভূরিয়া ছড়ায় এর দু’টি বধ্যভূমিতে থানা এলাকার এবং বাইরের নানাস্থল হতে ধরে আনা লোকজনকে পাশবিক নির্যাতন করে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এসব বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্রে অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল, মাথার খুলিতে ভরপুর ছিল ছোট নদী ভূরভূরিয়া বালিময় বেলা জলাভূমি। দীর্ঘ আট মাস লড়াইয়ের পর ৪ ডিসেম্বর ‘৭১ শ্রীমঙ্গল ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিবাহিনী কর্তৃক শত্রুমুক্ত হয়। শ্রীমঙ্গল ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল। এ সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ( সিআর দত্ত)