অদম্য ইতির স্বপ্নজয়: চা বাগান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পাশে দাঁড়াল জেলা ও পুলিশ প্রশাসন

সংগ্রাম দত্ত, মৌলভীবাজার: চা-বাগানের সীমাবদ্ধ জীবন, অভাব আর শত প্রতিকূলতাকে জয় করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন মৌলভীবাজারের ইতি গৌড়। কুলাউড়া উপজেলার বরমচাল চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের এই কন্যার অদম্য সংগ্রামের গল্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তার পাশে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার তাকে ডেকে নিয়ে শুভেচ্ছা জানান এবং আর্থিকভাবে সহায়তা করেন।

চা-বাগানের জীবন মানেই সীমাহীন পরিশ্রম আর সীমাবদ্ধতার গণ্ডি। কিন্তু সেই গণ্ডি পেরিয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন ইতি গৌড়। বরমচাল চা বাগানের রাস্তার পাশে একটি ছোট টিলার ওপর তাদের ঘর। অসুস্থ বাবা শংকর গৌড় ও চা-শ্রমিক মাসি ষষ্ঠী গৌড়কে নিয়ে তার বসবাস। ইতির জীবনসংগ্রাম শুরু হয় অনেক আগে। মা সুমিত্রা গৌড় ছিলেন চা-শ্রমিক, যিনি প্রায় দুই বছর আগে অসুস্থ হয়ে মারা যান। বাবা শংকর গৌড় বাপেক্সের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করলেও মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে ২০১৮ সালে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় মায়ের মৃত্যু আর বাবার অসুস্থতা ইতির শিক্ষাজীবনকে প্রায় থামিয়ে দিয়েছিল।
সেই কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়ান মাসি ষষ্ঠী গৌড়। নিজের আয়ে তিনি ইতিকে স্বপ্ন দেখতে সাহস জুগিয়েছেন। তিন বোনের মধ্যে ইতি সবার ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মেজ বোন ঢাকায় নার্সিং পড়ছেন। বাবার চিকিৎসা ও মেজ বোনের পড়াশোনার খরচ জোগাতে মা-বাবার শেষ সম্বল দুই বিঘা জমিও বিক্রি করতে হয়েছে তাদের।

বরমচাল চার্চ অব গড মিশন স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে বরমচাল উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এসএসসি এবং এম এ ইউসুফ গণি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন ইতি। ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়লেও কোনো প্রাইভেট বা কোচিংয়ের সুযোগ পাননি তিনি। নিজের আত্মবিশ্বাস ও কঠোর অধ্যবসায়ই ছিল তার একমাত্র পাথেয়।
এইচএসসির পর বড় বোনের উৎসাহে ঢাকায় গিয়ে ‘বর্ণ কোচিং’-এ ভর্তি হন এবং মেধার জোরে অর্জন করেন তিন মাসের পূর্ণাঙ্গ স্কলারশিপ। সেখান থেকেই শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় জয়ের প্রস্তুতি।

কঠোর পরিশ্রমের ফলও পান হাতে-নাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ’ ইউনিটে ফিন্যান্স বিভাগে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পাশাপাশি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিটে ৪০তম স্থান অর্জন করেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তির জন্য উত্তীর্ণ হন।
বরমচাল চা বাগান থেকে ইতিই প্রথম শিক্ষার্থী, যিনি কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলেন।

ইতির এই অভাবনীয় সাফল্যের খবর পেয়ে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম তাকে তার কার্যালয়ে আমন্ত্রণ জানান। গত ২৯ জুন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতির হাতে বিশ হাজার টাকার চেক তুলে দেন তিনি। একই দিনে জেলা পুলিশ সুপার মো. মনজুর রহমানও ইতিকে তার কার্যালয়ে ডেকে মিষ্টিমুখ করান এবং জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি তার পাশে দাঁড়িয়েছেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে ইতি বলেন, “আগে ভালোভাবে লেখাপড়া শেষ করতে চাই। ফিন্যান্সের পড়া শেষ করে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার ইচ্ছা আছে।”
কন্যার সাফল্যে আবেগাপ্লুত বাবা শংকর গৌড় বলেন, “বাপেক্সে চাকরি করার সময় বড় বড় স্যারদের দেখতাম, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তখন ভাবতাম, আমার কোনো মেয়ে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারত! ঈশ্বর আমার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। আমার স্ত্রী নিশ্চয়ই স্বর্গ থেকে মেয়েদের জন্য আশীর্বাদ করছেন।”

ইতি গৌড় আজ কেবল একটি নাম নয়, এটি এক সংগ্রামী জীবনের প্রতীক। তার এই সাফল্য সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর হাজারো শিক্ষার্থীর জন্য অনুপ্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে।

সম্পৃক্ত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button