মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: মৌলভীবাজার জেলা পরিষদে যোগদানের পরই আলাদিনের চেরাগের সন্ধান পান তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী তারেক আহমদ চৌধুরী। সিলেট শহরে কিনেছেন ফ্ল্যাট, শ্রীমঙ্গলে বাগান। এর বাইরেও নিজের ও স্ত্রীর নামে রয়েছে এফডিআর ও ব্যাংক ব্যালেন্স।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুয়া বিল ভাউচার করে টাকা আত্মসাৎ, সরকারি অর্থ রাজস্ব কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ, ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে পুরো টাকা আত্মসাৎ, জেলা পরিষদ অফিস, ডাকবাংলো ও অডিটোরিয়াম মেরামতের নামে ভুয়া প্রকল্প তৈরি সবই করেছেন তারেক আহমদ।
বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান যোগদানের আগ পর্যন্ত বেপরোয়াভাবে তিনি এসব অনিয়ম চালিয়েছেন। স্টাফদের কেউ তার অনিয়মের প্রতিবাদ করলেই মারধর করেন এবং চাকরিচ্যুতির হুমকি দেন। ইতোমধ্যে তিনি তিনজনকে মারধর করেছেন এবং একজনকে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে বাধ্য করেছেন। যার কারণে ভয়ে কেউই মুখ খুলতে চান না।
জানা যায়, ২০০৩ সালে তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের সুপারিশে সহকারী হিসাবরক্ষক হিসাবে মৌলভীবাজার জেলা পরিষদে যোগদান করেন তারেক। জেলা পরিষদে যোগদানের পূর্বে তিনি ডিশলাইনের লাইনম্যান হিসাবে কাজ করতেন।
সরেজমিন সিলেটে গিয়ে জানা গেছে, নগরীর সুবিদবাজার এলাকার ১৮৮ শুভেচ্ছা, মিয়া ফাজিল চিশতে আটতলা আপন গ্রিন টাওয়ারের সপ্তম তলার (সেভেন-ই) ফ্ল্যাটের মালিক তারেক আহমদ। ভবনের ম্যানেজার সোহাগ ও দারোয়ান সিরাজ বলেন, তারেক আহমদ পরিবার নিয়েই এখানে থাকেন।
স্থানীয়রা বলছেন, এ ফ্ল্যাটের দাম দুই কোটি টাকার উপরে। শ্রীমঙ্গল বিষামনী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুব আলম স্বপ্ন (জায়গা ক্রয়-বিক্রির মিডিয়া) বলেন, ফাইভ স্টার হোটেল গ্র্যান্ড সুলতানের বিপরীতে বেগুন বাড়ি নামে ১৮ একরের একটি বাগান ছিল তারেক আহমদের। ৬-৭ বছর পূর্বে শ্রীমঙ্গলের পাঁতাকুড়ি সোসাইটির কাছে দেড় কোটি টাকায় সেটি বিক্রি করেছেন।
এদিকে সদ্যবিদায়ি মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমানকে মারধরের ঘটনায় তিনি ২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খোদেজা খাতুনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। প্রধান নির্বাহীর সামনে উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে মারধর করা হয়। ওই ঘটনার বিচার আলোর মুখ দেখেনি। এ ঘটনার পর থেকে আরও বেপরোয়া হন তারেক।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ইলেকট্রিশিয়ান পিয়াস চন্দ দাসকে মেরে পা ভেঙে দিয়েছেন তারেক। চাকরিচ্যুতির ভয় দেখিয়ে মামলা করতে দেননি পিয়াসকে। বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে ঝাড়ুদার দুলাল ভাস্ককে দুই বছর আগে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে বাধ্য করেন তারেক।
পরিষদের একজন নারী কর্মচারীর সঙ্গে তারেকের রয়েছে অনৈতিক সম্পর্ক। পরিষদে প্রশিক্ষণ নিতে আসা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করারও অভিযোগ রয়েছে তারেকের বিরুদ্ধে।
নাম গোপন রাখার শর্তে চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারী যুগান্তরকে বলেন, ‘দুই আড়াই বছর আগে মৌলভীবাজার ডাকবাংলোর ভিআইপি রুম ঝাড়ু দিতে গিয়ে ঢুকেই হিসাবরক্ষক তারেক এবং জেলা পরিষদের স্টাফ ওই মহিলাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাকরির ভয়ে কেউ কথা বলতে পারেন না। সবসময় স্টাফদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখে।
সূত্র বলছে, মৌলভীবাজারেও একটি ভাড়া বাসা নিয়ে তারেক একা থাকেন। রাতে সেই বাসায় বসান আড্ডা। ইলেকট্রিশিয়ান পিয়াস চন্দ দাস বলেন, ‘ভাই আমার যা হওয়ার হয়ে গেছে, এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না। যার সঙ্গে পারব না, তাকে নিয়ে মন্তব্য করার সাহস আমার নেই। আমার বউ বাচ্চা নিয়ে থাকতে হবে।’
নানা অভিযোগের বিষয়ে তারেক আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার মোস্তফা শাহীন বলেন, আমি যোগদানের পর হিসাবরক্ষকের কর্মকাণ্ড শুনেছি। পূর্বের স্যাররা বা কর্তৃপক্ষ কী কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি জানি না। তবে এ বিষয়গুলো আমি খতিয়ে দেখব।